Wednesday, September 16, 2020

গল্প - তীর্থঙ্কর নন্দী


 অমনোনীত গল্প

----------------------


একটি গল্প কখনও কোথাও মনোনীত হয় না। কেন হয় না বোঝা মুশকিল। গল্পটি যেখানেই পাঠানো হক না কেন ঘুরে ফিরে ফেরত আসবেই। গল্পটির কোথায় সমস্যা কেন সমস্যা বোঝা যায় না। অমনোনীত গল্পটি শুরু হয় এই ভাবে। 

একটি প্রায় নির্জন রাস্তা চলে যায় এই শহরের দক্ষিণে। রাস্তাটি আসে শহরতলি থেকে। প্রায় নির্জন মানে ঘরবাড়ি আছে তবে একটু কম। ফাঁকা ফাঁকা। এখনও খালি জমি পড়ে থাকে বাঁ দিকে ডান দিকে। কয়েক বছর বাদে এই ফাঁকা জমিও ভরাট হয়ে যাবে। রাস্তাটি যতই দক্ষিণ শহরে এগোয় ততই রাস্তাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। ঘরবাড়ি যেন মুখের ওপর এসে পড়ে। এই দক্ষিণ শহরের রাস্তায় মোমোদের বাড়ি। মোমোরা থাকে। মোমো নামি স্কুলের ছাত্রী। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা একদিন খেয়াল করে মোমোকে নিতে স্কুলের গাড়ি আসে না। প্রায় এক সপ্তাহ বাদে মোমোকে আবার স্কুলে যেতে দেখতে পাওয়া যায়। কানাঘুষো শুনতে পায় এই এলাকার মানুষ যে এক সপ্তাহ নাকি মোমো বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কানাঘুষো খবরটি স্বভাবতই ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির পরিচারিকাদের মাধ্যমে। এই এলাকায় চারজন মহিলা ঘুরে ফিরে বারোটি বাড়িতে কাজ করে। খবর এদের মাধ্যমেই ছড়ায়। মোমোদের বাড়িতে যেই মহিলা কাজ করে প্রধানত সেই মহিলাই বাকি তিনজনকে জানায়। 

কথা হল মেয়েটি এক সপ্তাহ কোথায় থাকে! কেন থাকে! কীভাবে থাকে! আসল খবরটি কেউই জানতে পারে না। জানার কথাও নয়। কেননা মোমোর অভিভাবকেরা জানে মুখে কুলুপ এঁটে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিছুদিন বাদে সবকিছু চাপা পড়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ফলে মোমোর অদৃশ্য হওয়ার আসল কারণটি জানা যায় না বলেই কি গল্পটি অমনোনীত হয়! সম্পাদকেরা মনে হয় আসল কারণটি জানতে খুবই আগ্রহী। ফলে আসল কারণটি অজ্ঞাত থাকার ফলেই বোধ হয় কোন সম্পাদক গল্পটি প্রকাশ করতে রাজি হয় না। গল্পটি ঘুরে ফিরে ফেরত আসে। 


দেবদূত থাকে এই শহরের উত্তরে। দেবদূত ভালো ছাত্র। উচ্চবংশের ছেলে। উত্তরের শহরটি এখনও কেমন এলোমেলো। অগোছালো। রাস্তাঘাট ভাল হয়নি। প্রচুর ঘরবাড়ি। নোংরা। অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিবেশ এই উত্তর শহর। দেবদূত এই শহরের দক্ষিণে একটা স্কুলে পড়ত। ভাল স্কুল। কো-এড। দেবদূত এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। মোমো এই স্কুলেই পড়ে। এখনও পড়ে। দেবদূত আর মোমোর ভিতর এক ধরণের মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে দেবদূত যখন স্কুলের ছাত্র ছিল। সম্পর্কটি এখনও আছে। 

প্রায় প্রতিদিন আশেপাশের লোকেরা দেবদূতকে মোমোর বাড়ি আসতে দেখে। দেবদূতের একটি লাল রঙের মোটরবাইক আছে। ফলে বাইকটিকে মোমোর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো থাকলেই মানুষ বুঝে যায় বাইকের মালিক কোন বাড়িতে আসে। অবশ্য বর্তমানকালে একটি ছেলে একটি মেয়ের বাড়িতে রোজ আসবে গল্প করবে এটা কোন বিষয়ই নয়। দুজনেই যখন একই স্কুলে পড়ে। একই স্কুলের গল্প অন্যান্য বাড়িতেও আছে। থাকবে। ফলে এই সব দৃশ্য এই সব গল্প মানুষের কাছে আজ আর কোন নতুন নয়। পুরনো। একঘেয়ে বিষয়ে মানুষ এখন আর মন দেয় না। মোমো যখন তার বাড়ি থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায় তখন কিন্তু দেবদূতও আর মোমোর বাড়িতে আসত না। ফলে মোমোর আশেপাশের মানুষরা দেবদূতকে নিয়ে এক মনগড়া গল্প ফাঁদে। যে গল্প পরিচারিকাদের মুখ থেকে শোনা যায় না সেই গল্পই মোমোর প্রতিবেশীরা বলতে থাকে। তারা বলে মোমো নাকি দেবদূতকে নিয়েই কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ এই গল্পের কোনও সত্যতা নেই। কেননা মোমোর বাবা মা এই ধরণের কোনও কথা বাইরের লোক কিংবা থানাতে কখনও বলে নি। হয়তো এই সব মনগড়া গল্পের জন্যও কোনও সম্পাদক গল্পটি প্রকাশ করতে সাহস পায় না। গল্পটি অমনোনীতই থেকে যায়। 


আজ সোমবার। পয়লা ভাদ্র। গুমোট গরম চারিদিকে। শহরের বুকে কিংবা বলা যায় এই বিশ্বশহরে মানুষ কেমন অসহায়। এক অজানা ভাইরাসে গুমরে থাকে। মনে করে দিন দিন যেন মৃত্যু কাছে আসে। কিন্তু ঈশ্বরের জন্য অপেক্ষা করা যায়। তা বলে মৃত্যু! ইতিহাসে ত এমন কথা কেউ বলেনি যে মৃত্যুর জন্য কেউ অপেক্ষা করে! কিন্তু তমালিকা করে। তমালিকা এখন দিনরাত মৃত্যু চায়। চায় মৃত্যু যেন তাকে গ্রাস করে। এই মৃত্যু চাওয়ার ভিতর যথেষ্ট কারণ আছে। 

কে এই তমালিকা! কেন সে দিনরাত মৃত্যুকামনা করে! তমালিকা থাকে শহরতলীতে। রূপগঞ্জে। এই শহর থেকে রূপগঞ্জে যেতে মাত্র তিনঘণ্টা লাগে বাসে। রূপগঞ্জের অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে তমালিকা। বাবা ছিল উকিল। মামা উকিল। কাকা উকিল। দুদিকের দাদুরাও উকিল। মানে উকিল পরিবার। তমালিকাও উকিল হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। পড়াশোনার মাঝেই তমালিকার বিয়ে হয়ে যায়। স্কুলে পড়াশোনার সময়ই তমালিকা উকিলের স্বপ্ন দেখে। যেহেতু পরিবারের সবাই উকিল আর উকিল। তমালিকার বিয়ে হয় একজন নামজাদা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। তমালিকার পিতা ঈশ্বর প্রমোদরঞ্জন মহাশয় তমালিকার বিয়ে নিজে হাতে দিয়ে যান। অত্যন্ত পণ্ডিত বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন। পাত্র নির্বাচনেও কোনও ভুল ছিল না। অন্তত বিয়ে পর্যন্ত। 

কথায় আছে যত গোল বাঁধে পরে। কিন্তু সর্বত্রই কি গোল বাঁধে! গোল বাঁধাটাই কি নিয়তি! তাহলে ত সবার জীবনেই বিয়ের পর গোল বেঁধে যেত। কিন্তু যায়নি ত! তমালিকার বন্ধু নীলাদ্রি ত বেশ আছে। নীলাদ্রির বন্ধু ঋতমাও ত বেশ আছে। তাহলে! ভাগ্যবিচারকেরা বলে সবই নাকি ভাগ্য। তমালিকা একদিন শহরে আসে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে। সেদিন ছিল ঝলমলে আকাশ। শীতকাল। দুজনে মিলে ঘুরতে যায় ময়দানে। ময়দানে চক্কর মারতে মারতে বসে পড়ে এক টিয়াপাখি বিচারকের কাছে। টিয়াপাখি কত বড় বিচারক! কত বড় উকিল! লোকে বলে টিয়াপাখি নাকি সব নিখুঁত বলতে পারে। দুই বন্ধু টিয়াপাখির কাছে বসে বিচার চায়। সবুজ টিয়াপাখি লাল ঠোঁট নিয়ে দুই বন্ধুর ভাগ্যগণনা করে। ভাগ্যে বলা থাকে দুজনেই কপালমন্দা। 

তমালিকা যে কপালমন্দা সেটা তমালিকার থেকে কেউ ভাল জানে না। ছ বছরের মাথায় স্বামী ধীমান তমালিকাকে ছেড়ে চলে যায়। তমালিকা সেই থেকে এক ছেলেকে নিয়ে বাবা মার কাছেই থাকে। ধীমান কেন ছেড়ে যায় কী তার আসল কারণ সেই কথা কেউ জানে না। সেই রহস্য একমাত্র ধীমান আর তমালিকাই জানে। এই অসহ্য জীবন তমালিকার একদম ভাল লাগে না। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর কথা ভাবে। আত্মহত্যার কথা ভাবে। কিন্তু আত্মহত্যা থেকে বার বার ফিরে আসে একমাত্র ছেলের জন্য। ধীমান আর তমালিকার বৈবাহিক জীবন কেন সুখের হল না সেই রহস্য পরিষ্কার হয় না বলেই কি গল্পটি মনোনীত হয় না কোথাও। গল্পটি অমনোনীতই থেকে যায়।


শান্তিনগরে থাকে বব আর ববি। এই শহর থেকে শান্তিনগর বেশ দূরে। নিজস্ব গাড়ি থাকলে ছ ঘণ্টা। বাসে সাত ঘণ্টা। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জায়গা শান্তিনগর। লোকে বলে এই কারণেই নাকি নাম শান্তিনগর। অনেকটা জায়গা নিয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা একটি অঞ্চল আছে। নাম শান্তিবন। মানুষ প্রতিদিন বিকালে এখানে এসে একটু শান্তি খোঁজে। মনের আরাম খোঁজে।

বব আর ববি শৈশবের বন্ধু। শুধু শৈশবের কেন হবে! বালক বয়সের যুবক বয়সেরও বন্ধু। এখন তো দুজনে মাঝবয়সে দাঁড়িয়ে। যুবক থাকতেই দুজনে মিলে একটি ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়। ওদের ব্যবসার সুনাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসার দৌলতে দুজনেই আজ বেশ ধনী। দুজনেরই বিদেশি গাড়ি। দুই বন্ধুর এমন ভাল সম্পর্ক খুব কমই চোখে দেখা যায়। যেন হরিহর আত্মা। কাজে কর্মে যখনই দুজনে বিদেশে যায় সঙ্গে দুই পরিবারও থাকে। বেশ চলছিল ব্যবসা ও বন্ধুত্ব। 

শান্তিনগরের মানুষ এখন অন্য ছবি দেখে। ছবিটি বেশিদিনের না। মাত্র এক সপ্তাহ হয়তো হবে। বব ববির মুখোমুখি হলে দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আবার ববি ববের মুখোমুখি হলে দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। কেন এমন হল বাইরের কেউ জানে না। কার দোষ কেউ বুঝতে পারে না। অফিস ঘরটি তালাবন্ধ। অথচ এই অফিসেই এক সময় কত মানুষ আসত। গমগম করত। এখন চুপচাপ। দুজনের এই তেতো সম্পর্কের জন্য শান্তিনগরের মানুষের ভিতরেই এক অশান্তি। প্রায় দিন বিকালেই দুই বন্ধু শান্তিবনে আসত। গল্প করত। ব্যবসা নিয়ে আলোচনা চলত। শান্তিতে দুজনের কত কথা হত। বিকালে যারা এইখানে আসত সবাই দুই বন্ধুচিত্র দেখে অভ্যস্ত ছিল। আজ আর দুই বন্ধু এই বনে আসে না। বসে না। গল্পও করে না। দুই বন্ধুর অনুপস্থিতির জন্য বিকালে যেন মানুষের চোখে শান্তিবন কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগে। ধূসর লাগে। 

দুই বন্ধুর নিমসম্পর্কের জন্য কে দায়ী! বব না ববি! মানুষ কিছুই বুঝতে পারে না বাইরে থেকে। তারা শুধু দেখে একটি মধুর সম্পর্ক কীভাবে রাতারাতি তলানিতে এসে ঠেকে। কীভাবে সম্পর্কটির পতন হয়। পতন কি অর্থের জন্য! অতিলোভের জন্য! না অন্য কিছু! শান্তিনগরের মানুষদের কাছে এই রহস্য কখনও পরিষ্কার হয় না। হবেও না। ফলে শান্তিনগরের মানুষের কাছে যদি গল্পটি অধরা থাকে তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকের কাছে গল্পটি কীভাবে ধরা দেবে! সেই জন্য গল্পটি আজও অমনোনীত। কোথাও ছাপা হল না।


অলংকরণ- কার্তিক ঢক্

4 comments:

  1. ভাল লাগলো খূব

    ReplyDelete
  2. অকাট্য সত্য।

    ReplyDelete
  3. বেশ ভালো গল্প। টান টান ঘটনার স্রোত। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  4. আপনার গল্পে এক জাদু রয়েছে। শুরু থেকে এমন আকর্ষণ তৈরি হয় যার রেশ গল্পের শেষেও রয়ে যায়!

    ReplyDelete

কথামুখ

 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য...