নিজ-হাতে-বানানোর গল্প যখন বাজারের থেকে কিনে আনা
একবার একটি মোমবাতি তৈরি করেছিলাম।ক্লাস ফাইভে পড়ি।সে-সময় মামাবাড়ির কয়েকজন বন্ধু মিলে,মৌমাছি পরিত্যক্ত একটি মৌচাক গাছ থেকে পেড়ে এনেছিলাম।সেটিকে আগুনে গলিয়ে,যেটুকু মোম ছিল গলিয়ে নিলাম।তারপর একটি পেঁপের নলে একটি সরু সুতো গলিয়ে,সুতোটিকে মাঝ বরাবর রেখে,গলানো মোম ঢেলে দিলাম।পেঁপে নলটির নীচের ছিদ্রটি গোবর দিয়ে বন্ধ করে রাখা ছিল,যাতে মোম বেরিয়ে না-যায়।এভাবে নলে ঢালা মোম ঠাণ্ডা হলে,নলটিকে সাবধানে ছড়িয়ে,মোমবাতির 'ইউরেকা'টিকে বের করে এনেছিলাম।তারপর সে নিজ-হাতে-গড়া' মোমবাতির আলোয় সন্ধ্যা থেকে কত রাধ অবধি আমাদের গল্প বলার ও শোনার আসর জমেছিল।বড়রাও কেউ কেউ তাতে যোগ দিয়েছিল।
কাগজের নৌকা যে বার প্রথম বানাতে শিখলাম,সেদিনের জলে যে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল,কিংবা প্রথম ঘুড়ি যেদিন বানাতে পেরেছিলাম,সেদিন বাতাসে ওড়ার খুশি যতদূর উঠতে পেরেছিল,তেমনটি বোধহয় কোনদিন হয় নি।আজই বাচ্চাদের "হারিয়ে যাওয়া কালিকলম' বলে গদ্যটি পড়াচ্ছিলাম।সেখানে গদ্যকারদের শৈশবে কীভাবে কলম ও কালি বানানো হতো তার নিখুঁত বর্ণনা আছে।তিনি লিখছেন,"তিল এিফলা শিমুল ছালা ছাগদুগ্ধে করি মেলা /লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি ছিড়ে পত্র না ছাড়ে মসি।" অর্থাৎ ঘরোয়া উপায়ে ভালো কালি তৈরি করার এই উপাদান।গদ্যকার আরও বলেছেন,কালি তৈরির এত উপাদান সকলের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব ছিল না,তাই তাঁরা সহজপ্রাপ্র্য উপাদানে কালি তৈরি করতেন।উনুনে পোড়া হাঁড়ির নীচের কালিও তাঁরা ব্যবহার করতেন।এসব পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল,এই কালি তৈরি করাকে কেন্দ্র করে,সে-সময়ের মানুষেরা কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন,সে কথা।
আমরা যখন উচচবিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম,তখন না-ছিল আমাদের সাইকেল,না ছিল বাস,বা পুলকার।আমরা ক্ষেতের আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে রোজ স্কুল যেতাম।সেই আলপথ,সেইসব ক্ষেত,পাশের সরু বনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে কতকিছু আবিষ্কার করতাম,আর তার আনন্দে আমাদের মন উদ্বেল হতো।সাপ,ব্যাঙ,পাখি সকলের সঙ্গেই চেনাশোনা হত।ধানের সবুজ চারা থেকে হলুদ ফসলে পরিণত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়কে,আমরা কৌতূহলী মন নিয়ে দেখেছি,আবিষ্কার করেছি,আর ইউরেকা হয়ে গেছে আমাদের হৃদয়।
ক্লাস ফাইভে যখন আমরা মোমবাতি বানাই,তখন কিন্তু বাজারে যথেষ্ট মোমবাতি পাওয়া যেত।আমরা যখন প্রথম ঘুড়ি বানাই,বা কাগজের নৌকা বানাই,তখন এগুলোর বিকল্পও ছিল মার্কেটে।কিন্তু আমাদের অভিভাবকেরা অনেকেই এসব বানানো থেকে আমাদের বিরত করে বলেন নি : এসব করে টাইম নষ্ট করে কী হবে,বাজার থেকে কিনে আনলেই হবে।আমরা তাই সানন্দে এসব আবিষ্কার করার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পেরেছি।যতদিন যাচ্ছে,আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তার সব আবিষ্কারের ভার বাজারের উপর অর্পন করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছে।এখন এমনই একটা ক্যাচলাইন দি মোস্ট পপুলার,টাকা কামালেই সব আসবে।আর তাই বাচ্চারা নিজের হাতে কেউ মোমবাতি,ঘুড়ি,নৌকা,পুতুল বানায় না।সব আসে বাজার থেকে।বাবারা নিয়ে আসে।
শুধু কি বাচ্চারা,বড়রাই বা নিজেরা নিজের হাতে কোন আবিষ্কারের ঝুঁকি নেয় ? নিজের হাতে কিছু করাকেই তো আজকাল বোরিং,লেবারিং,টাইম ওয়েস্টিং ভাবছে সকলেই।এখন তো বহু পরিবারের খাবার পর্যন্ত হোটেল থেকে আসছে ! নিজের হাতে এটুকু করতেও সময় নেই।শিশুর পরিচর্যার ভার তো কবেই গেছে,বাজারের দিদিমণির হাতে ; আরেকটু প্রগতিশীল মা তো বাচ্চাও চাইছেন বাজার থেকে,তিনি নিজের গর্ভের শিশুটিকে আবিষ্কারের ঝুঁকিটাও নিতে চান না।বাচ্চার নিজের হাতে ঘুড়ি তৈরি বন্ধ হওয়া থেকে,মায়ের নিজের গর্ভে সন্তান গ্রহণ বন্ধ হওয়া অনেকগুলো সামাজিক স্তরে বিভক্ত। সমাজের একেবারে নিচুতলায় হয়তো এই স্তরের প্রাথমিক দশা( বাচ্চাদের নিজের হাতে ঘুড়ি বানানো বন্ধ হওয়া) দেখা যাচ্ছে বলে,সেখানেও এর ভয়াবহ দশাটি (মায়ের নিজের গর্ভে সন্তান না-ধারণ করার ইচ্ছে) আসতে যে খুব বেশিদিন লাগবে,তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।এভাবেই তবু সমাজ চলছে,এগিয়ে চলছে ?
চলতে বাধা কোথায় ? বেঁচে থাকার মূল উপাদানগুলো যতক্ষণ মানুষের হাতে আসবে,ততক্ষণ মানুষের বেঁচে থাকারই তো কথা।কিন্তু বেঁচে থাকার মতো বেঁচে থাকার প্রশ্নটি এলে নড়ে বসতে হয় কি ! মানুষ সমাজবদ্ধ জীব।একা সে বেঁচে থাকতে পারে না।এই সঙ্গে থাকার অর্থটি কিন্তু কোনমতেই বাজারি নয় ; এটি আত্মিক।মানুষ যদি তার সব আনন্দ,সব খুশির জন্য বাজারের উপর নির্ভর করে,তাহলে এই আত্মিক বন্ধনটি ছিন্ন হবেই।তখন না-থাকবে পারস্পরিক সমাজবদ্ধতা,না-থাকবে পারিবারিক বন্ধন,না-প্রেম,না-সংসার।মানুষ তখন হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন,একা,অবসন্ন ও আত্মঘাতী।
সংসারে প্রতিদিন যে রান্না হয়,তা বাজার থেকে এনেও খাওয়া যায় ; কিন্তু এই রান্নাকে কেন্দ্র করে সংসারে যে গাঢ় প্রণয়ের প্রকাশ ঘটে তা বাজারে মেলে ? ঠিক সেরকমই,শিশু থেকে বড় সকলেই নিজে নিজে যা তৈরি করে,বানায়,তা বাজার থেকে আনাই যায়,কিন্তু এইসব নিজহাতে বানানোর ভিতরে যে গল্প ও অভিজ্ঞতা হয়,তা বাজার থেকে কেনা যায় ? বনভোজনে যারা মার্কেট থেকে কেনা খাবার নিয়ে যায়,তারা কি আর বুঝবে,বনভোজন করতে গিয়ে কাঁচা কাঠের ধোঁয়া খেয়ে চোখে জল পড়ার আনন্দ কী ? বাজারমুখী থেকে বাজারসর্বস্ব মানুষ কবে বুঝবে,এইসব নিজ হাতে বানানোর গল্প ও অভিজ্ঞতাই একটি মানুষকে আরেকটি মানুষের সঙ্গে জুড়ে রাখে,বিচিত্র সম্পর্কের বন্ধনে।বেঁচে থাকাকে বেঁচের থাকার বহুরৈখিক আনন্দে।
অলংকরণ- কার্তিক ঢক্
No comments:
Post a Comment