Wednesday, September 16, 2020

মুক্তগদ্য - দিশারী মুখোপাধ্যায়


প্রভাতপ্রতিমের বিবর্তন 

----------------------------------



জেগে উঠবার আগেই আরো গাঢ় ঘুমে তলিয়ে চলেন প্রভাতপ্রতিম। 

বারবার যেন কেউ জলতলের অতল থেকে তাঁকে তুলে আনে পৃথিবীর আলোয় বাতাসে , মুহূর্তেই নিক্ষেপ করে আরও নিচে আরও অন্ধকারে , বারবার অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেয় ,আবার পরায় । এইভাবে প্রভাতপ্রতিম কমা-হাইফেন-কোমার ভেতর স্মৃতিতে ছিলেন

নাকি চেতনার ভগ্নাংশে , সেই চেতনারই তীব্র  হুলে ,-  বিব্রত বিবর্তন বুঝতে পারেনি । ডাক্তার , নার্স আর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আরও কিছু মানুষ যারা আসেপাশে ছিল , তারা ছিল উদাসীন আর কর্তব্যমুখর। 

ভাবনা বা চিন্তাকে তারা সমাদরে আপ্যায়নে অভ্যস্ত নয় 


হসপিটালে বাবার বেডের পাশে বসে থাকে বিবর্তন , ঘন্টাঘন্টা , দিনরাত , দিনদিন ।আর প্রায় সবসময়ই চলতে থাকে একটা তথ্যচিত্র ,চোখের সামনে তার ।কখনো নির্বাকচিত্র , কখনো সবাক ।

শুরু হওয়া জীবনের অন্তহীন পথে তার বাবা কখনো সম্পূর্ণ একা 

কখনো উজান-শক্তিতে ভরা এক ভীড়ের বিপরীতে ।কখনো সে সুকান্তের রানার , কখনো আনন্দে চাষ করার জলরঙ ।আবার কখনো আশ্বিনের ঝড়ে হেলে পড়া বটবৃক্ষ ,যে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য নতুন উপক্রমণিকা তৈরি করছে ।

জলে ভেসে গেছে সম্পূর্ণ গ্রাম, হাজার খানেক মানুষ আশ্রয় ভিক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে আছে তিনচারটি বড়লোকের বহুতল আবাসের 

লোহার গেটের বাইরে ।প্রভাতপ্রতিম দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে 

তাদের সঙ্গে ।আবেদন করছে বিডিওর কাছে , মানুষের দুর্গতির কথা লিখে পাঠাচ্ছে জেলাশাসকের কাছে । কোথাও থেকে কোনো সূর্যোদয়ের খবর নেই ।

তবু না শব্দটির ভূমিকা অপরিসীম হয়নি কখনো ।


হাসপাতালের বাইরে সম্পূর্ণ পৃথিবীটা যখন কালো মখমলের বিছানার উপর রঙিন স্বপ্নের আসন বুনছে , তখন এই মেডিকেল ওয়ার্ডের পঞ্চাশজন রোগীর মধ্যে কারো কারো গলা থেকে ক্ষীণ আর্তশব্দ শুকনো পাতার মত এধার ওধার ছিটকে পড়ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় ।

এরই মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য স্থানুপাথর হয়ে পড়েছিল বিবর্তন ।  তাকিয়ে দেখে বাবার দিকে ,

বসে আছে বিছানার উপর , অক্সিজেন স্যালাইন সব খুলে ।দুহাতের চ্যানেল থেকে টসটস করে গড়িয়ে পড়ছে নীল রক্ত ।

- একি বাবা !  তুমি সব খুলে ফেললে ! আঁতকে ওঠে বিবর্তন ।

- এবার তো খুলে ফেলারই সময় এসেছে ।জুড়ে চলার চেষ্টা যত করেছি জীবনভর , তারই বা কোন ফলাফল ? আমাদের জীবন একটা চিত্রনাট্য , যেটা লিখে দেয় , পরিচালনা করে অন্য কেউ বা অন্য অনেকে ।আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে ব্যতিরেকে ,আমাদের সেই নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে যাপনের অধিকার শুধু ।তাইতো সেই অচেনা সৌরশক্তি ,যে আমাকে বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছে ,যে আমাকে অগস্ত্য , অতীশ দীপংকর কিংবা তেনজিং-এর দীপ্ত সব ক্রোমোজোমের দিয়েছে উত্তরাধিকার ,সে-ই আমার চিত্রনাট্যে 

আমার মা ভাইবোনকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষে ! 


বিবর্তন খু্ব কোমল কণ্ঠে বিশ্বাসকে বেশ কিছুটা দৃঢ়তা দিয়ে 

বাবার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে 

- সে তো তোমার আজীবনের বন্ধু , তোমার লড়াই , যে কেবল তোমার পেশিকেই শক্ত করেনি , জীবনের যে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর 

লিখেছ তোমার নোনা দিনলিপি ।হাজার বছরের শিলালিপিও তার কাছে স্পষ্টতার বিধান চেয়েছে । 

উত্তরে ঝিম হয়ে আসা বাবার গলা থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ বার হয় ,যার অনুবাদ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়না বিবর্তনের ।

- আর সেই লড়াই ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে আটআনা বারোআনার উপার্জন দিয়ে আমি তোমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ তৈরি করেছি নিজে হাতে । তার নিউক্লিয়াস , প্রোটোপ্লাজম , মেমব্রেন সব । 

- তোমার এই সাফল্যই তো আমাদের শিখিয়েছে বৃক্ষ রোপনের যাবতীয় কলা । মাটি কেটে তুমি তুলে আনতে মিষ্টিজল , পাথরের ভেতর থেকে । নিজে হাতে বার করে আনতে মাখন । বাতাসের বুকের মধ্যে পৃথিবীর সঙ্গীত আবিষ্কৃত হবে বলে অপেক্ষায় আছে ,

ডিমের কুসুম । সেই সত্য তুমি ভিন্ন আর কোনো বিজ্ঞানীর কাছে আমরা অর্জন করিনি । তবে এখন তুমি কী খুলে ফেলার কথা বলছ? কেন বলছ ? জুড়ে চলার সব চেষ্টা তোমার ব্যর্থ ! 


- ব্যর্থ হয়তো নয় ঠিক । মৃত্যুর দংশনে ভুল হয়েছে কিছুটা । তবে সে সত্যকে অশ্বত্থ বৃক্ষের মত পুঁতে যেতে পেরেছি কি ? পেরেছি কি সে বৃক্ষকে অন্তহীন মেরুদণ্ড দিতে ? পারিনি নিশ্চিত । 

- সে একটা ঘটমান বর্তমান । সে একটা এমন পল যার দুদিক থেকে টেনে বড় করলে শেষ হবার নয় , সেই বৃদ্ধিকে রিলে করতে হয় । 


প্রভাতপ্রতিম মৃদু হাসি মুখে নিয়ে বাতাসে আল্পনা এঁকে দিল 

- এইটেই ধ্রুব সত্য বিবর্তন ,  এই সত্যে তোমার ভেতরও আমি বর্তমান । এভাবেই মানুষ অমৃতের পুত্র । আমি শুধু বুঝতে চেয়েছিলাম যে অভিনয়টুকু পরিবেশনের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয়েছে , তার জন্য তুমি ঠিক তৈরি কতটুকু ।এখন নিশ্চিন্ত আমি ।

এবার আমাকে শুইয়ে দাও । অক্সিজেন আর স্যালাইন যেমন ছিল করে দাও,  ডাক্তারের আসবার সময় হল বোধহয় ।এসেই তিনি আমার পাল্স দেখবেন । তারপর চোখ থেকে চশমা খুলে ,তোমার কাঁধে হাত রেখে , একটু নিচু কণ্ঠে বলবেন  - 

হি ইজ নো মোর ।


হাল্কা একটা তন্দ্রাভাব কিংবা ক্লান্তির জুলুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা বিবর্তন হঠাৎ একটা ঝটকা অনুভব করে ।ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুক ।

চোখ মেলে দেখে - বাবা যেরকম অচৈতন্য অবস্থায় ছিল সেরকমই আছে ।বুকের উপর হাত দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসটুকু অনুভব করে ।


সমস্ত ওয়ার্ড জুড়ে বাইরে থেকে আসা ভোরের আলো আলতো লেগে আছে ।যে দুএকটি রোগীর যন্ত্রণার মৃদু শব্দ সারারাত তার হাতের ঘড়ির সঙ্গে একটানা সঙ্গত দিয়েছে ,তারাও এখন ঘুমের চাদরে ঢেকে গেছে । দুজন সিস্টার তাদের হিলতোলা জুতোর মিষ্টি শব্দে রোগীদের কাছে গিয়ে সকালের মেডিসিন ডেকে ডেকে ধরিয়ে দিচ্ছেন । ব্লাড ,অক্সিজেন, স্যালাইন ,জ্বরদেখা এইসব দেখে নিচ্ছেন জনে জনে । 

উদাস দৃষ্টিতে এইসব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বিবর্তন নিরুদ্বিগ্ন , যেন তার আপন রোগীর জন্য ভালোমন্দ জানবার আর কিছু নেই । 

সিস্টার এলেন , রোগীকে দেখলেন , পাল্স দেখলেন , চোখের পাতা উল্টে দেখলেন টর্চের আলোয় । বিবর্তনকে উদ্দেশ্য করে বললেন 

-আপনি তো সারারাত জেগে ,বাড়ি থেকে কাউকে ডেকে নিন।তারপর ওয়ার্ড ছেড়ে দ্রুত চলে গেলেন । 

আর একজন নার্স আটচল্লিশ নম্বর বেডের রোগীর মুখের উপর সাদা চাদরটা দেখে দিলেন । বারো নম্বর বেডের রোগী একটানা 

অস্পষ্ট শব্দে বলে চলেছে - জীবন , ও জীবন , একটু কাছে আয় বাবা ...জীবন , ও জীবন


( ছবি- ইন্টারনেট) 

1 comment:

কথামুখ

 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য...