ভাদু : একটি বিস্মৃত লোকগান
সেদিন বিনোদনের অপর নাম মোবাইল ছিল না । দেবদেবীর আবাহন বা বিসর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল না শব্দদানব ডিজে । সেদিন কার্টুনের টম জেরিও ছিল না । তাই মা গান গেয়ে বা ছড়া কেটে ছেলেমেয়েকে খাওয়াতো, ঘুম পাড়াতো । সেদিন টিভি সিরিয়ালের কূটকচালির বদলে, গাঁয়ের মেয়েবউদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল পাখির কাকলির মতো শান্ত, সুমিষ্ট সুরের গান । গান ছিল তাদের মান অভিমান , হাসি কান্নার দোসর । সেদিন পুরুষেরা নদীতে মাছ ধরে গিয়ে, সাগরে নৌকা বাইতে গিয়ে এমনকি ছাদ পিটাই করতে করতে গান গাইত , মেয়ে বউরা ঢেকিতে পাড় দিত, ক্ষেতে ধান লাগাত গান গেয়ে -
“কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদি ঘরে কি কর
হাতের জালি লয়ে কাঁখে সুখসায়রে মাছ ধর ।
মাছ ধরণে গেলে ভাদু ধানের গুছি ভেঙো না
একগুছি ধান ভাঙলে পরে পাঁচশিকা জরিমানা ।।’’
এভাবেই অধিকাংশ মেয়েলি ব্রতের মতো ভাদু গানেও জায়গা করে নিয়েছিল ছড়া , কখনো বা গান । এই গানগুলি সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতার দলিল ।
অবিভক্ত মানভূমের অন্যতম লোকপার্বণ ভাদু । আগে পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদ্র সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিটি সন্ধ্যায় গাঁয়ের অধিকাংশ পরিবারে ভাদুর অর্চনা চলত । তাই মানুষের সুখে দুঃখে আহারে নৈবেদ্যে জড়িয়ে গিয়েছিল ভাদুগান । বাতাসে কান পাতলেই শোনা যেত ভাদুকে নিয়ে গড়ে ওঠা নানান কিংবদন্তী । প্রচলিত লোককথা অনুসারে , ভাদু কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিংদেও এর প্রজাদরদী কৃষ্ণপ্রাণা কন্যা । পাশের লাড়া গ্রামের এক চাষীর ছেলের সঙ্গে ভাদু প্রণয়পাশে জড়িয়ে পড়লেও সে প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ।বিবাহের রাতে তাঁর প্রেমিক খুন হলে যন্ত্রণাবিধুরা ভাদু আত্মহত্যা করে। ভাদুর স্মৃতিকে অমলিন করে রাখতে কাশীপুরের রাজপরিবার ভাদুগানের প্রচলন করে । কিন্তু কাশীপুরের রাজপুরোহিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ‘পঞ্চকোটের ইতিহাস’ গ্রন্থে রাজা নীলমণি সিংদেও এর তিনজন রানীর গর্ভে দশজন পুত্রসন্তানের কথা উল্লেখ করলেও রাজার কোনো কন্যা সন্তানের উল্লেখ করেননি । তাছাড়া ভাদু প্রধানত আনন্দ উৎসব । ভাদ্রসংক্রান্তিতে ভাদুর জাগরণের দিনে খাজা গজা জিলিপিসহ নানান মিষ্টান্নের প্রাচুর্য দেখেই বোঝা যায় এখানে শোকের চিহ্নমাত্র নেই । ভাদুগানেও দেখা যায় আনন্দ হুল্লোড় -
“বলি ও ললিতে ! চল না সবে যাব ভাদু দেখিতে ।
তোরা তাড়াতাড়ি গয়না শাড়ি পরে চল মোদের সাথে ।।
খোঁপা ঝুঁটি বাঁধবি আঁটি গো, ঝুমকা নিবি সিঁথিতে
আবার পায়ের চটি ভুলিস না নিতে লো নইলে ভুগবি কুলআঁটিতে ।
জয়বাংলার হিড়িক এল লো, চশমা নিবি চোখেতে ।”
আনুমানিক পঞ্চাশ বছর বয়স্কা কাজল গরাঁইয়ের কিশোরীকালের খাতা থেকে পাওয়া উপরোক্ত গানে দেখা যায় ভাদু পার্বণ মানেই বাহারি সাজপোষাক পরে বান্ধবীদের সঙ্গে ভাদু দেখতে বেরিয়ে গান আর আনন্দশ্রোতে ভেসে যাওয়া -
“ ভাদু দরশনে এসেছ সবে আমাদের ভাগ্যগুণে ।
এলে যদি দয়া করে গো বাহিরে কেনে ?
এসো ঘরের ভিতরেতে গো , বস গো এই আসনে ।।
শুধু শুধু ভাদু দেখে ফিরে যাবে কেমনে !
ভাদুর গান শোনাব গান শুনিব আইন আছে এইখানে ।।”
আবার আশির গণ্ডী পেরোনো কাজল গঁরাইয়ের শাশুড়ি সিমলাপাল থানার পুখুরিয়া পোস্টঅফিসের অন্তর্গত পচাপাথর গ্রামের কালিদাসী গঁরাই স্মৃতি হাতড়ে তুলে এনেছেন যে ভাদুগান সেখানে ভাদু যেন রাধা হয়ে যায় –
“ আখবাড়িতে ঢাক বাইজছে গো ,আইসছে আমার ভাদুধন
চেয়ে দেখ রে ব্রজের বালক কতদূরে বৃন্দাবন !
বৃন্দাবনের ভাদু তুমি বৃন্দাবনে কি কর
কে বা তোমার মাতা পিতা কার বা তুমি আশ কর । ”
লক্ষীসাগরের বাউরিসোল গ্রামের স্বপন পাইনের কাছ থেকে পাওয়া রেণুকা পাইনের ভাদুগানগুলিতে ভাদুর রূপবর্ণনার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে আগমনি গানের সুর –
“ ভাদু আমার সনার যাদু সাত রাজার ধন মণি গো ।
বছর পরে এলে ভাদু যেন রূপের খনি গো ।।
ও গঙ্গাজল যাও ছুটে যাও নিয়ে এস সিংহাসন
তাতে বসিয়ে ভাদুধনকে কেশ দিয়ে মোছাব চরণ ।।
জামাই বড় আদরের ধন জামাই কেন আসে না !
বল বল ব্যাপার কী লো ভালো কি সে বাসে না ?
পিরিত চাবুক দিয়ে ভাদু যাবে ঘোড়ায় চড়ে গো ।
দেখব কেমন রাজার ব্যাটা ! আনব তারে ধরে গো ।।
কোকিল ডাকে বকুল শাখে , পায়রা ডাকে বাকুড়কুম ।
বেলা আটটা বেজে গেল ভাঙল না ত ভাদুর ঘুম ।।
উঠ উঠ উঠ ভাদু নয়ন মেলে বারেক চাও ।
আজ তিনদিন খাও না কিছু উঠে কিছু মুখে দাও ।।
নইতন পুকুরের পাড়ে পায়রা গুমগুম করে গো ।
পায়রা লয় মা , পাখি লয় মা , ভাদু খেলা করে গো ।।
তারই পাশে পদ্মপুকুর জল টলমল করে গো ।
যেও না যেও বা ভাদু পিছলে পড়ে যাবে গো ।।
ভাদু আমার সনার যাদু সাত রাজার ধন মণি গো ।
বছর পরে এলে ভাদু যেন রূপের খনি গো ।।”
বৈষ্ণব কবির লেখা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার মতো ভাদুর বাল্যলীলা ফুটে উঠেছে স্বভাবকবির উপরোক্ত ছত্রগুলিতে । হয়তো প্রথাগত ছন্দে সেরকম দক্ষতা না থাকার কারণে উপরোক্ত গীতিকার বারংবার ‘গো’ ধুয়াপদটি ব্যবহার করেছেন ।
এই তিরিশ দিনে আদরের ভাদু আরাধনা করতে যাবার সময় গাঁয়ের মেয়ে বউরা ভাদুর জন্য নিয়ে যেত খাজা গজা জিলিপি , এমনকি চিনি দিয়ে দুধের সর পর্যন্ত । এতদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে ভাদু শেষঅব্দি আর দেবী থাকে না , বরং ঘরের মেয়ে হয়ে যায় । তাই ভাদুকে মুড়ি, কলাই ভাজা দিতেও মা মেয়েদের কুণ্ঠা হয় না । এমনকি তাঁরা অনায়াসে ভাদুকে মুড়ি ভাজতেও বসিয়ে দিতে পারে ‘আমার ভাদু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝন্ ঝন্ করে লো’। ভাদ্রমাসের শেষদিন ভাদুকে বিদায় দিতে গিয়ে তাই দুঃখের মেঘ ঘনিয়ে আসে মায়ের মনে, ভাদুর সঙ্গী সাথীদের চোখে জলের ধারা বাঁধ মানে না। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া রঘুনাথপুরের গোবিন্দপুর গ্রামের জারুবালা মাজী স্মৃতি থেকে উদ্ধার করলেন এরকমই একটি গান -
“ তিরিশ দিন যে রাইখ্লম ভাদু মা বই্লে আর ডাই্কলে না
যাবার সময় রগড় ধর মাকে ছাড়া যাব না ।
যাই্ছ যাই্ছ যাই্ছ ভাদু পিছু দিকে তাকাও না
পিছু দিকে সতীন আছে পান দিলে পান খাইও না ।
যাই্ছ যাই্ছ যাই্ছ ভাদু দু’পাশাড়ি ভাই্ল না
নয়নলালায় জল পালাই্ছে সংতীর মন ভাইব না ।।”
আবার রঘুনাথপুর শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের ভাদুপালনকারিণী সত্তর বছর পেরোনো কণিকা মাজীর খাতা থেকে পাওয়া গানগুলির বিষয়বস্তু রামায়ণ, মহাভারত, শিব পুরাণের বিভিন্ন পালা । তিনি এই গানগুলিকে বলেছেন ‘ভারতভাঙা গান’ । অর্থাৎ মহাভারত ভেঙে গ্রামের কোনো অর্ধশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত কবির কলমে এই গানগুলি লেখা হয়েছিল ।তাঁর খাতা থেকে পাওয়া গানগুলি হল ১) প্রহ্লাদচরিত্র বা হিরণ্যকশিপু বধ ২ ) শিবের ধ্যানভঙ্গ ৩) রাবণের যুদ্ধে গমণ ও লক্ষণের শক্তিশেল 8) গঙ্গার উৎপত্তি ও ভগীরথের জন্ম ৫ ) দাতা কর্ণ প্রভৃতি । প্রসঙ্গত বলে রাখি , মহাভারত বা রামায়ণ নিয়ে লেখা এইসব গানগুলি বনেদী বাড়ির ভাদুমণ্ডপে সুর করে গাওয়া হত । আর কথা না বাড়িয়ে আমি বরং ‘দাতাকর্ণ’ থেকে সামান্য অংশ তুলে দিই –
“একদিন বাসুদেব ভাবিল অন্তরে ।
কর্ণ সে কেমন দাতা বুঝিব তাহারে ।।
যে যাহা মাগে কর্ণ তাহা দেয় দান ।
সবে বলে দাতা নাই কর্ণের সমান ।।
হরি বলেন যাব আমি কর্ণের নিকটে
বুঝিব সে কর্ণ বীর কেমন দাতা বটে ।
এই কথা মনে করি প্রভু নারায়ণ
মায়া করি হইল এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ।।’’
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ভাদ্রের অলস সন্ধ্যায় কণিকাদেবী এখন টিভি সিরিয়ালে মজে থাকেন । ভাদুগান করেন না । কালিদাসী গঁরাইয়ের নাতবউ, কাজল গঁরাইয়ের পুত্রবধু ঝুমা গঁরাইও বর্তমানে ছেলেমেয়ের অক্ষরশিক্ষায় কাজে মগ্ন থাকেন বেশিরভাগ সময় , অবসর সময়ে মোবাইলে গান শোনেন । কখনো জারুবালাদেবী নাতনী বা নাতজামাইয়ের আবদার মেটাতে স্মৃতির পাতা হাতড়ে দু এক কলি গাইতে চেষ্টা করলেও ভাদু গানে আর মুখর হয় না পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা সন্ধ্যাগুলি । আগে ভাদ্রসংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ পয়লা আশ্বিন ভাদুকে বিসর্জন দিতে লক্ষীসাগরে বিশাল শোভাযাত্রা বের হত, ভাদুর শ্বশুরবাড়ি যাত্রায় সঙ্গে দেওয়া হত আয়না চিরুনি, তেল সিঁদুর আলতা, এমনকি খাট পালঙ্ক, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি পর্যন্ত । ভাদুর শেষযাত্রায় সঙ্গী গাঁয়ের মেয়ে বউরা যেত গান গাইতে গাইতে -
“ জলে হেল জলে খেল জলে তোমার কি বটে !
আপনার মনকে ভাইবে দেখ জলে শ্বশুরঘর বটে ।।”
লক্ষীসাগরের কানাই চন্দ , বনমালী ডাঙ্গুরিয়া, আশিস চন্দ এখনো ভাদু গড়েন । তাঁদের ভাদুর কোলে শোভা পায় কখনো কৃষ্ণ, কখনো টিয়া পাখি, তারা ভাদুর হাতে দেন পান সুপুরি, কখনো ভাদুর হাতে থাকে পদ্ম, কখনো বা শঙ্খ । ভাদুপুজো উপলক্ষে এখনো জিলিপি বানান পাড়ার মিষ্টি দোকানি । কিন্ত আজ ভাদুর আসরে শব্দদানব ডিজে বাজে । গাঁয়ের লোকজন আগের মতোই শোভাযাত্রা বের করে শখের ভাদুকে বিসর্জন দিতে যায় পাশের শিলাবতী নদীতে । কিন্তু ভাদু গান আর শোনা যায় না । কৃষ্ণের বাঁশির শ্রবণ-প্রত্যাশী রাধার মতোই ভাদ্রের ভ্যাপসা সন্ধ্যাগুলিতে ভাদুগানের জন্য আমাদের মন আকুলি-বিকুলি করে ।
ছবি- লেখক
একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ লেখা। ঋদ্ধ হলাম। কিন্তু খিদে আরো বেড়ে গেলো। অপেক্ষায় রইলাম। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ReplyDeleteBhalo laglo
ReplyDelete