Wednesday, September 16, 2020

গুচ্ছ কবিতা - অচিন্ত্য মাজী


 


স্পর্শ
--------

আমি তার স্পর্শ পেয়েছি একেবারে কাছ থেকে/ তিনি তখন দাওয়ায় বসে মহাশূন্য দেখছিলেন/ পলকহীন চোখে চক্কর দিয়ে উঠছে টনটনে নীল/ খড়িওঠা চামড়ার ভাঁজে নরম ধুলার ছোপ/ হিমেল দুপুরের ঝিমানো রোদটুকু চাখছেন/ কতবেলের শাঁসের মতো হালকা মিঠে হালকা টক সে আস্বাদ/ ক্রমাগত পাক খাচ্ছে ব্রহ্মনাভির কেন্দ্রস্থলে/ পাতাল গহ্বর থেকে মধুর বোঁ বোঁ ধ্বনি / ক্রমশই ছিটকে যেতে লাগল অতিদূর পাহাড় শিরে/ যেন সুনিপুণ রমণের হ্রেষা/ বলগাহীন হয়ে কুপোকাত করে দেবে প্রার্থিব শৃঙ্খল/ ওর অতি ধীর চোখের কোটরে উঁকি দিচ্ছে সবুজ বুনো বীজ।

আমি দেখছি পরম আহ্লাদের মাতন চরম রিরংসার সঞ্চারকে/ কঠিন ঝঞ্ঝার মধ্যে ফেলে/ হাঁটু গেঁড়ে বসেছেন বিজ্ঞ প্রবীণ যুবক/ তার টালমাটাল কররেখায়/ তীব্র প্রতাপের শীৎকার/ একটি পবিত্র মুহুর্তের স্তবকে বুনে চলেছেন আশ্চর্য নিরহংকার দিয়ে/ অপরিসীম সিন্ধু গর্জনের আড়ালে/ অতিমানবিক সেই দীনতা শীর্ণ শূন্য দেহের ভেতরে/ জ্যোৎস্নার স্বচ্ছতা হয়ে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে।


উপহার
----------
সমস্ত দরজা খুলে দিলে ঐ আলো এসে পড়ে/ কেউ দেখতে পায় না কারণ মাঝ রাত্তিরে সে আসে/ সাদায় ছোপানো নীল পাখনা মুড়ে আয়েসে বসে কাঠের দোলনায়/ ঘরময় রঙিন পালক ওড়ে/ মঘা নক্ষত্রের বিনয়ের মতো খয়েরি আঁশ জ্বলজ্বল  করে/ তার অপূর্ব সন্ধিগ্ধ দৃষ্টির ভেতর বহুপুরাতন বিশ্বাস/ মোমের পোঁচের মতো আলুলায়িত অথচ ঘন/ উজ্জ্বল আগুনের গর্তে প্রসবের শিথিলতা/ বাগানের বিদঘুটে আঁধারে তখন নিঃশব্দ দাপাদাপি/ একটি অতিক্রমণের কাছে নিথর হয়ে আছে ভৌতিক চলাফেরা/ ঘাড় কুঁজো হাড় বের করা শরীর অদ্ভুত ঢঙে নেতিয়ে/ খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে প্রচন্ড স্তব্ধতার মাংস/ কানা চোখের পাতলা জালিতে ফুটে উঠছে / অন্তর্গত ক্ষরণের বিচিত্র নকশা/ খাওয়া শেষ করে সে একলক্ষ বছরের বিষাদ/ আর এক লক্ষ বছরের বিশ্বাস আমাকে দিয়ে/ অকস্মাৎ অন্তর্হিত হল তুমুল কৃষ্ণ বিবরে।



খবর
-------

অল্প অল্প করে গুটোতে শিখেছি/ শিখেছি টানটান সুতো ছেড়ে দিতে/ রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে অভ্যাস করছি/ সমস্ত অনায়ত্ত পরিমণ্ডলকে বিঁধে দেওয়ার কৌশল/ লাল সবুজ প্যারাশুটের খোঁদলে মুণ্ড গলিয়ে/ পৃথিবীর অনুর্বর ভূমির ক্ষতো আর প্রতাপ দেখছি/ সেই পুড়ে যাওয়া ঘা যেখানে পিদিম কখনো জ্বলেনি/ শুধু আলকাতরার মতো ঠাণ্ডা একটি কালো/ চেরাজিভ দিয়ে শুষে নিত চমৎকার ভোজবাজী।

আমার এই ছোট্ট মাটির ঘরের জানালায়/ বৈশাখের সান্ধ্য মেঘ গড়িয়ে ঢুকে যায়/ কুচো কুচো বরফ শিলা সাদা তুলোর আঁশের মতো ছটফটায়/ কচি শিমুলের ডাক থেকে উড়ে আসে ছেঁড়া পাতা/ শুকনো বাকল জল খেয়ে ঢোল হয়ে ফুলে উঠলে/ ভেতর থেকে পেঁচিয়ে ওঠে পিচ্ছিল বুনো কীট।

এই নির্বাক সায়াহ্নে আনকোরা বৃষ্টির ছাঁট মেখে/ শিরদাঁড়া চনমনে আর ফুরফুরে হতেই/ অদৃশ্য ফণার আঘাতে নেতিয়ে যায় মুগ্ধ উত্থান/ কালো ডালপালার ফাঁক দিয়ে অষ্টাবক্র তক্ষক / আচ্ছন্ন কামনায় হিসহিস করে মুখের লালা ছোঁড়ে/ জানলায় বাঁশের বাতার চৌখুপি থেকে/ আবার পলকা কাটা রোদ্দুর গড়িয়ে পড়তেই/ আমার সমস্ত শিথিল সুতো টানটান হয়ে যায়।                       

অনুপ্রবেশ
-------------


জলের ভেতরে তার রজত ডানা ঝরে গেছে/ সোনালি আঁশগুলো এঁকে বেকে ঢুকে যাচ্ছে গুপ্ত কপাটিকায়/ অরণ্য চোখের আগুন সমুদ্র গর্ভের পলল ও প্রবালে / থিতিয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো জাগর তৃষা নিয়ে মৎস্য কঙ্কালের পাঁকাল আঁধারে আশ্রয় নিল/ শবের কোটরে রাশি রাশি সবুজ দীপিকা/ জৈব লতাপাতার আড়ালে শলাকার মতো তীক্ষ/ চারপাশের মসীবর্ণ জলে কোঁকড়ানো/ শ্যাওলার গায়ে/ জলের দেবী সংগোপনে খুলে রেখেছেন হৃদয়।

তুমি উপবাসী অতিথি আঁশটে গন্ধ পেয়ে/ চলে এসেছো টলটলে জলের অতলে/ সহস্র ক্ষতের প্রজ্জ্বালিকা অঙ্গে জড়িয়ে/ পৌঁছে যাবে টাটকা নিষুতির নিরুপদ্রব রমণে।

জলপৃষ্ঠে কাঁপুনি দিয়ে ফুটল ক্ষীণ তপ্ত চাবুকের আভা।


প্রতিশোধ
-------------


খড়বিচালি পচাপাতা বাকলের স্তুপে বহুদিন চাপা পড়ে আছ/ সবাই খোঁজ করে কিন্তু কেউ দেখতে পায় না/ মাঝে মাঝে ঝুরো স্তুপ উড়ে যায়/ সন্ধ্যার আলগা পাতলা মেঘপুঞ্জ থেকে মৃত্যুর ছিটে এসে লাগে/ খয়েরি কালো মাটির ভাঁজে পিদিমের লাল চোখ উঁকি মারে/ অর্ধ জাগ্রত অর্ধসুপ্ত বাঁকা নিশ্বাস চাপা হয়ে ফোঁসে/ তুমি কুমারী শিশু, ভূমির ভেতরে গেঁথে দিয়ে গেছে চণ্ডাল পোড়া হাড়, শুদ্ধ করে দেবে বলে/ অনশ্বর শেকড় নাভি থেকে ছিঁড়ে গেছে কবে/ সেই হাঁ মুখ শুষে নেয় রাজকীয় ক্রোধ/ রক্তজিভ দুলে ওঠে খড়্গাঘাতে/ নরম পলকা মাটির ভেতর ধুন্ধুমার প্রলয়/ একটুকরো শলাকা হয়ে উড়ে এল মরণবীজ/ সভ্যতার চক্ষুহীন কোটরে।


অলংকরণ- কার্তিক ঢক্

No comments:

Post a Comment

কথামুখ

 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য...