বনে বাদাড়েঃ দাঁদড়ের সাহিত্যসাধক
---------------------------------------------
পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানার অন্তর্গত একটি প্রত্নস্থল। লৌলাড়া। গ্রামে যে তিনটি প্রাচীন জৈন মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, তাদের শিল্পকলা দেখে অনুমান করা হয় যে, সেগুলি নবম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল।
একটি আদিনাথ। ৮৪ সেন্টিমিটার x ৫০ সেন্টিমিটার মাপের পঞ্চরথ শৈলীর মূর্তিটির শিরোদেশ ত্রিছত্র শোভিত ও পশ্চাতে প্রভাবলী। মূর্তির দুই পাশে মালা হাতে অভ্যর্থকদের মূর্তি, দুজন পরিকরদের মূর্তি এবং ছটি সারিতে দ্বিতীর্থিকা মূর্তির ছটি করে সারি অবস্থিত।
আরেকটি অপরিচিত মূর্তি। ৭৭ সেন্টিমিটার x ৮৭ সেন্টিমিটার মাপের ভগ্নছত্র মূর্তির পশ্চাতে প্রভাবলী। মূর্তির দুই পাশে মালা হাতে অভ্যর্থকদের মূর্তি, পার্শ্বদেবতা ও জ্যোতিষ্কদেবগণের মূর্তি বর্তমান।
আরেকটিও অপরিচিত। ৬৪ সেন্টিমিটার x ৪১ সেন্টিমিটার মাপের ভগ্নছত্র মূর্তি। বিশ্বকমলের ওপর সমভঙ্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান।
এক গ্রীষ্মের দুপুরে দাঁদড় আশ্রমে ঘুরে ঘুরে মূর্তি, কথকথা, ইতিহাস নিয়ে কথা হচ্ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রায় ছ ফুট লম্বা। ঋজু, মেদহীন, মেরুদন্ড সোজা করে চলা মানুষটিকে দেখে বোঝার যো নেই যে তিনি সত্তোরোরধ।
পুরুলিয়ার দুপুর মানে লু। কিন্তু গাছগাছালির ঘন আচ্ছাদনে এক শীতলতার পরশ। মনেও।
সেই প্রথম আলাপ। যেন মহিমামণ্ডিত হয় এই উঁকি দেয়া, রোদের। গাছের ফাঁকে। যার আভা এসে লাগে শাল, মহুল, পলাশে। ডেকে ওঠে ময়না, খঞ্জনা। দাঁদড় গোপাল আশ্রম প্রাঙ্গণে। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী বিরজানন্দ ভারতী। ক্ষ্যাপা মনোহর ঠাকুর নামেই এলাকায় জানত লোকে। ওনার আগে নাকি আরো ১০৭ জন সাধক এই একই স্থানে সাধনা করেছিলেন।
বলেন কি? ১০৮ জন!
গোপাল বাবা বহু বছর সাধনা করেন এখানে। বসেন পঞ্চমুণ্ডির আসনে। সাধনার ফলে স্বয়ং বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিয়ে পদচিহ্ন রেখে যান। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকাল অবশ্য ১৯৭২। বললেন উনি।
প্রানান্তকর পরিশ্রম করে একটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ সম্পাদনা করেন সুভাষ বাবু। দাঁদড়। জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যায় বিজ্ঞাপন যোগাড়ে। কিন্তু খামতি নেই। তাগাদা দিয়ে সেরা লেখাটি লিখিয়ে নিতে জুড়ি মেলা ভার আমার সম্পাদকের। পুজো সংখ্যার জন্য প্রচ্ছদ চাই। একটা বড় লেখাও। আমার পুরুলিয়ার অফিসে এক কাপ চা খেয়ে ওঠার সময় বলে যেতেন।
যুদ্ধ মনে করেন না জীবনটাকে। যাপন করেন। অকুন্ঠ ভালোবাসাও ঝোলা ভর্তি হয়ে থাকে। ওনার ভাগের ভালোবাসা অন্য কেই বা নেবে। মহাশ্বেতা দেবী চিঠি লিখে পাঠান। নতুন কাগজ, তার সামনে সম্ভাবনা অনেক। বিশেষ করে এই জেলায়, যেখানে দাঁদড় পত্রিকার খুব দরকার আছে। একই সঙ্গে জল-জমি-অরণ্য-পশুপাখি এসব রক্ষা করবার প্রয়োজন সম্বন্ধে জনচেতনা জাগাবার প্রয়াসও এই পত্রিকা করুক। সুভাষ নিশ্চয় এ বিষয়ে মনোযোগী হবে।
লাগাতার এই বানী পাথেয় করেই চলেছেন লোকটি। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল স্বীকৃতি পান। মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়ায় এসে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সাহিত্যসেবীকে। মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে সাক্ষী থাকি আমি।
সাহিত্যসেবীকে বলেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত খাদে পড়ে যে রাখালের বাঁশির ধ্বনি থেমে থাকে না, শীতের ভোরের দূর্বাঘাসের ঠোঁটে একবিন্দু শিশিরের প্রতিচ্ছবি, জ্যোৎস্না রাত্রে বসুন্ধরাকে রহস্যময়ী নারীর রূপে কল্পনা করা, ভাঙ্গা কাঁসর ঘন্টা থেকে বেছে ওঠা পুরনো জীবনের ছন্দ, নীল আকাশের চোখের চাওয়ার অব্যক্ত আকুলতা যাদের ভাষায় কোনদিন প্রকাশ করা যাবে না, তাই সাহিত্য। সংলগ্ন বা অসংলগ্ন কিছু কথা লিখে যাই। হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি। যে হাসি রসসিক্ত। একান্ত অন্তরের।
দাঁদড়ে সাধক বোধহয় ১০৯ জন। একজন এখনও সাধনারত। সাহিত্যব্রতী। ওনার ধ্যানের চেয়ে কখনো বেশি মূল্য যেন না-পায় কোনো অবাস্তবতা। মানুষই যেন হয় প্রকৃত সাধক। পাখির কণ্ঠে যেন ভাসে ওই গান, মানুষের।
No comments:
Post a Comment