Wednesday, September 16, 2020

নিবন্ধ - অভিজিৎ দাশগুপ্ত

সুকুমারী ভট্টাচার্য

 সমাজতন্ত্রের ধারা ও সুকুমারী ভট্টাচার্য 
-----------------------------------------------------

অভিজিৎ দাশগুপ্ত


" মুক্তি , মুক্তি এখন ---                                           ক্ষোভ আর ক্রোধের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে  আসছি    আমরা , 
মুক্তি এখন । "

পাশ্চাত্যে নারীর ভোটাধিকারের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে নারী আন্দোলনের জন্য বেটি ফ্রিডান একটি সংগীত রচনা করেন । এটি তার প্রথম অংশ। বর্তমান সময়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আন্দোলনকারী নারী ধীরে ধীরে তার নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করেছে সোচ্চারে। 


কিন্তু কেন এই অবস্থা ? তাহলে আমাদের চলে যেতে হবে অতীতে । অতীত অর্থে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে সমাজে । যে সমাজে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে পড়ছে কৃষি , ধাতু ( ব্রোঞ্জ) এবং উন্নত জীবন পদ্ধতি। সুকুমারী ভট্টাচার্যর চিন্তার ক্ষুধা বীজ ধরা আছে এমন- ই কিছুর বিপরীতে । তাই মহাকাব্য , পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে তিনি যখন আমাদের পুরোনো অভ্যাসকে ত্যাগ করে নতুন পথের হদিস দেন , তখন সেই বহুপ্রসবী ভাবনা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে অতীতে পৃথিবীর সব জায়গায় নারীদের অবস্থা একই ছিল ছিল । মধ্যযুগ পর্যন্ত তার কোনো প্রতিবাদ তৈরি হয়নি হয়নি প্রতিবাদ তৈরি হয়নি হয়নি । নারী সেদিন পর্যন্ত ছিলেন ----

"বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ
পতিসেবা গুরৌবাসঃ গৃহার্থোহগ্নি পরিক্রিয়া।। "
                                          মনুস্মৃতি ২ । ৬৬ , ৬৮
( স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহই  বৈদিক সংস্কার  ; তাহার পক্ষে স্বামীসেবাই গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম্ম করাই তাহার যজ্ঞ।) 


ব্রেটি ফ্রিডান ,  সিমন দ্য বোভোয়া , সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখেরা  এই  ' নামহীন সমস্যা 'র বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়েছিলেন আজীবন। ফ্রিডান রচিত ' দি ফেমিনিন মিস্টিক '  বইটিকে মারিয়া ম্যান্ স ট্রিগারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন । আমেরিকার গৃহবধূদের প্রচুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের প্রচুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের অতৃপ্তির কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি । জীবন যে কতখানি শূন্য হতে পারে; নারীর  একক অস্তিত্বের ক্ষেত্রে তা প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল । ফ্রিডান তাঁর বইতে নারী কে আবিষ্কার করেছেন স্বামীকে আনন্দে রাখার মধ্যে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার মধ্যে আর অবশ্যই ভাল রান্না বিশেষ করে মুরগির মাংস তৈরির মধ্যে। 


সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রাচীন সাহিত্যের একজন গবেষক-  পাঠক । চিন্তা - উদ্দীপক তাঁর লেখাগুলি আমাদের অতীতকে সঞ্জীবিত করে নতুন দর্শনে । ঋক্ বেদের যুগ ও তার পরের সময়ে নারী নারী কীভাবে প্রান্তিক হয়ে যায় তার বিশ্লেষণে তিনি ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যাযাবর পশুচারী আর্যরা উত্তর ভারতে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আর্যাবর্তে নতুন এক জীবনধারার প্রচলন হয় । এক জায়গায় স্থায়ী হবার পর পর স্থায়ী হবার পর পর হবার পর পূর্বের গোষ্ঠী, কৌম ইত্যাদি ভেঙে গিয়ে কুল বা পরিবারের জন্ম হয়। এ পরিবার যৌথ যৌথ । সমাজের বিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে অর্থনীতিও ধীরে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল যাচ্ছিল ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল । যে কৃষি একদিন একদিন নারীদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল , সেখানে তাদের অধিকারও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে । " উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশ ক্রমেই  কমে যাচ্ছিল , যদিও গৃহকর্মে তার পরিশ্রম ও দায়িত্ব যথেষ্টই ছিল তবু তাকে ' ভার্যা ' অর্থাৎ অন্যের দ্বারা প্রতিপালিত এই সংজ্ঞা দেওয়া দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে ' ভৃত্য '  আর   'ভার্যা ' শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ একই : যাকে ভরণ করতে হয় । স্ত্রী স্বয়ং অন্ন উৎপাদন করে না তাই সে ভরণীয়া ---- একথা  বলছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। এ হল পরিহাসের চূড়ান্ত । যে নারী একদিন গাছের জন্ম কৌশল , বীজের ধর্ম খুঁজে পেয়েছিল --- যার কৌশল প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদনে অংশ নিত ; তাকেই শেষ পর্যন্ত ' ভরণীয় ' হয়ে থাকতে হবে চিরটাকাল। 


সমগ্র বৈদিক সাহিত্যে একমাত্র ঋক্ বেদেই নারীকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় । যদিও ঋগ্বেদ রচনার রচনার কয়েকটি স্তর আছে । তার প্রথম দিককার মন্ত্রগুলিতেই নারীর স্বাধীনচেতা ভাবটি বর্ণিত । যেমন --- " যমযমী সূক্তে (১০/১০) ভাই বোনের ও নাভানেদিষ্ঠ সূক্তে (১০/৬১/৫-৭)  পিতা পুত্রীর আসক্তির কথা আছে , ...। ...ঋক্ বেদে সহমরণে,পরবর্তীকালে যাকে সতীদাহ বলা হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ নেই ;  বিধবা বেঁচেই থাকতো, কখন - বা দেওরের সঙ্গে বিয়ে হতো তার, আর কখন- বা আর বিয়েই হতো না না হতো না না । "
                                ( ' বৈদিক সমাজে নারীর স্থান ') 


ঋক্ বেদের যুগ পার হলেই একটা বিরাট পরিবর্তন চোখে পড়ে । তখন গৃহকর্ম ভিন্ন আর কোনো বৃত্তি নেই তার নেই তার বৃত্তি নেই তার নেই তার । প্রতিবাদ অথবা নিজের ইচ্ছার কথা জানাতে পারবে না সে । যেমন --- ' বিবাহের সব কটি মন্ত্রেই উচ্চারণ করে বলা হয় স্ত্রী যেন চিন্তায় ও কাজে স্বামীর অনুবর্তিনী হয় , স্বামীর চিত্তের অনুগামিনী অনুগামিনী হয়;  কোথাও বলা নেই , স্ত্রীরও চিত্ত বলে একটা কিছু আছে এবং স্বামীকে তার প্রতি অনুকূল হতে হবে হতে হতে হবে । ' এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্য ভবিষ্যৎ চিন্তার বৃত্তটিকে  চিহ্নিত করেছেন । তাঁর স্পষ্ট অভিমত --- " পরবর্তী সাহিত্য যে নারীকে ভোগ্যবস্তু ও পণ্যদ্রব্য বলতে সাহস করেছে তার জোরটা যুগিয়েছে বৈদিক সাহিত্যই। ক্রমেই অবশ্য ঐ ভোগ্যত্ব ও  পণ্যত্বেই জোর দেওয়া বেড়েছে । " এমনকি রামায়ণে তার ছাপ পড়েছে রামের কথায়। অশোকবনে কাটিয়ে আসা সীতাকে তিনি ' ভোগ ' করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। 


নিরঙ্কুশ শাসন আর শোষণ মানুষ কোনদিনই মেনে নেয় নি নি । অন্যান্য সভ্যতাতেও একই ঘটনা। তাই ' ... নারী এই শতাব্দীতেই  প্রথম অধিকার সচেতন হয়েছে , আগে সে অত্যাচারিতা বন্দিনীই ছিল । ' বেটি ফ্রিডান,সিমন দ্য বোভায়া, ম্যারি স্টোপস্ , শার্লোট উলফ্ প্রমুখেরা এগিয়ে এসেছেন নারীর ভবিষ্যৎ জীবনকে সুরক্ষিত করতে। 


বেদ গবেষণায় ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য । আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী হয়েও প্রতিবাদী ভূমিকাটি বিস্মৃত হননি কোনোদিনই । ২০০৯ নন্দীগ্রামের ঘটনা তার প্রমাণ ।  একদিকে নারী আর অন্যদিকে নিচুতলার মানুষ --- এই দুই ছিল তাঁর জগৎ। 

আমাদের আক্ষেপ একজন মেধা পাটেকর, একজন রেখা কালিন্দী , একজন গুলশান পর্ভিন, একজন শর্মিলা চানু বর্তমানে থাকা সত্বেও নারীর অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে হয় আমৃত্যু। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্য দিয়ে সেই পথকেই খুলে দিয়েছিলেন বহুদিন আগে। 

তথ্যসূত্রঃ ১.প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য --- 
                   সুকুমারী ভট্টাচার্য। 
                 ২. পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন --- ঊর্মি
                     রহমান। 
                 ৩. স্বদেশচর্চা লোক। নানারূপে নারী ১:
                      সম্পাদক --- প্রণব সরকার।

No comments:

Post a Comment

কথামুখ

 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য...