গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলা কবিতার শক্তিশালী স্বর কবি অমিত সরকার। অনুসন্ধিৎসু পাঠক মহলে তাঁর কাব্যভাষার পৃথক কদর রয়েছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির উজ্জ্বল মেধার ছাত্র অমিত সরকার প্রযুক্তিবিদের পেশা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু দেশ। বিচিত্র অভিজ্ঞতার ফসলে ঋদ্ধ হয়েছে লেখনী। বহুকৌণিক ও বহুরৈখিক কাব্যস্বর সমবায়ে বাংলা কবিতার নিজস্ব কাঠামো নির্মাণে তিনি সফল। সামাজিক সঙ্গরোধের করোনাবর্তী সময়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন বইতরণী'র পক্ষে কবি মনোতোষ আচার্য।
মনোতোষ আচার্যঃ নমস্কার অমিতদা, আমরা জানি আপনার জন্ম ১৯৬১--এর ২৪ নভেম্বর, হাওড়ার শিবপুরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল- ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা বেরোলো। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে মোটামুটি সিরিয়াস কবিতা লিখতে শুরু করলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনি চেনা মুখ অথচ আপনার প্রথম কবিতার বই বেরোলো এই তো সেদিন ২০১২ সালে। প্রথম কবিতা প্রকাশ থেকে প্রথম কবিতার বই প্রকাশের ব্যবধানের নিরিখে আপনি সম্ভবত বাংলায় রেকর্ড গড়লেন। এমনটা হওয়ার কারন কী ?
অমিত সরকারঃ দেখো, পেশা একটা অত্যন্ত জরুরী প্রক্রিয়া। যাপন সংগঠিত করার জন্যে প্রত্যেককে তার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। আর কবিতা একজন ধান্দাবাজ হারামী প্রেমিকা, যে শুধু তোমার রক্ত খাবার জন্যে বসে আছে, তবু এই সত্য জেনেও তাকে ছাড়া যায় না। আমি দীর্ঘ দীর্ঘ সময় গোপনে তার সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে থেকেছি। কিন্তু পেশার তাগিদে তাকে তুলে এনে ঘরে বসানোর এই সাহস/ সুবিধে/ সুযোগ তৈরি হতে হতে আমার অনেকটা সময় খরচ হয়ে গেছে। তুমি একে ব্যক্তিগত মূর্খতা বলতেই পারো বা বলতে পারো অক্ষমের অজুহাত, যা খুশি ।
মনোতোষ আচার্যঃ লেখালেখির আদ্য-প্রহরে কাকে বা কাদেরকে মেন্টর হিসেবে পেয়েছিলেন?
অমিত সরকারঃ একদম শুরুতে আমার বাড়ির উল্টোদিকে একটা প্রেস ছিল। ‘ভাবীযুগ প্রেস’ সেখানে সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন। মূলত রাজনৈতিক কর্মী, কিন্তু লেখালিখি করতেন। ওনার অনেকগুলো উপন্যাসও আছে। তো ওনার একটা কাগজ ছিল, সেটার নামও ‘ভাবীযুগ’। রাজনৈতিক হলেও ওই কাগজে কবিতা, গল্প এইসবও ছাপা হত। আমি ক্লাস নাইন থেকেই এর প্রতিটা সংখ্যা পড়তাম, তবে তখন আমার মূল আকর্ষণ ছিল প্রবন্ধ। বামঘেঁষা রাজনৈতিক সাহিত্যের দিকে একটা আপাত লিনিয়ার টান আমার তৈরি হচ্ছিল। ওই প্রেসে প্রতি রবিবার সকালে কেউ কেউ আসতেন, খানিক কবিতাপাঠ, খানিক সাহিত্য আলোচনা, একটু ননফর্মাল স্টাইলে। সদ্য গজানো শিঙের সুড়সুড়ি নিয়ে আমিও ওখানে গুঁতিয়েছি কিছুদিন। একদিন সুশীলবাবু ওখানেই আমার কবিতা চাইলেন। ওই কাগজেই প্রথম আমার কবিতা বেরোল স্কুল ম্যাগাজিনের বাইরে। সালটা সাতাত্তর আটাত্তর হবে। অনেক লিখেছি ওই কাগজে। তারপর ওখান থেকেই ধীরে ধীরে আলাপ হল কবি গৌতম চৌধুরী ও অন্যান্য অনেক স্থানীয় কবিদের সঙ্গে। এখানে গৌতম চৌধুরীর কথাটা একটু বিশেষ, কারণ প্রাথমিকভাবে আমার কবিতাযাপনের পুরো পাঠটাই ওনার কাছ থেকে পাওয়া। ওনার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ নেই। তবু ‘মেন্টর’ শব্দটি বললে গৌতমদার নামই আমি প্রথমে করতে বাধ্য। আমার নিজস্ব কবিতারুচি উনি হাতে ধরে তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন কফিহাউসে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন কবিতাজগতের সঙ্গে।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার ছাত্র জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা যা আজও আপনাকে একান্তে নাড়া দিয়ে যায়?
অমিত সরকারঃ ক্লাস সেভেনের একটি ঘটনা বলছি। আমার ক্লাসের একটি ছেলে খেলার মাঝখানে হঠাৎ আর
একটি ছেলের তলপেটে ঘুষি মেরে বসে। দ্বিতীয় ছেলেটি লুটিয়ে পড়ে, মাঠে থাকার এবং একই দলে খেলার সুবাদে আমিও ওকে ধরে ধরে ক্লাসরুমে নিয়ে গেলাম। দশ মিনিটের মধ্যে শুনলাম ও নাকি মরে গেছে। আমরা কেউই সঠিকভাবে বুঝতে পারি নি। আর অতটা চোখের সামনে একটি সমবয়সী মৃত্যু…, জাস্ট নিতে পারি না আজও। ওর রোগা মুখ আজও হন্ট করে।
আর একটি ঘটনা। গৌতম কর নামে আমার এক সহপাঠী বন্ধু। সে কোথায় আজ আমি জানি না, ও দক্ষিণীতে রবীন্দ্রসংগীত শিখত। খুব ভালো গাইতো, এবং একটু এফিমিনেট ছিল। অন্য ছেলেরা প্রায়ই ওকে টিজ করতো। তখন তো এত সচেতনতা ছিল না। আমি ক্লাসে একা ওকে প্রোটেক্ট করতাম বলতে পারো। একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। আমি ফুটবল মাঠ থেকে ভিজে একশা হয়ে ক্লাসে এসেছি নিজের স্কুলব্যাগটা নিয়ে বাড়ি ফিরব বলে। দেখি ও একা একা ক্লাসে বসে কাঁদছে। আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন করাতে ও বলেছিল ওর খুব ভয় করছে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলাম। আর গৌতম কান্না বন্ধ করে আমাকে একা একা একটি অসাধারণ গান শুনিয়েছিল, ‘বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী’। গৌতম, তুই যদি কোনভাবে এই লেখা পড়িস তো নিশ্চয় যোগাযোগ করিস।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কাব্য-জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে কে বা কারা ?
অমিত সরকারঃ সেভাবে বললে কেউ না। আমার কবিতাজীবনের বেড়ে ওঠা আমার একান্ত নিজস্ব। নিজের ছাড়া এতে কারোর প্রভাব নেই।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নি উৎসব এবং' (২০১২) প্রকাশের অনুভূতি কেমন?
অমিত সরকারঃ ভাঙা নৌকার নাবিকের কাছে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া কম্পাসের মতো। সেই মুহূর্তেই আমি নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম আমার আগামী যাপনচিত্র কী হতে চলেছে।
মনোতোষ আচার্যঃ আবেগ ও মেধার মধ্যে কবিতায় কোনটি প্রধান হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
অমিত সরকারঃ আমি তীব্রভাবে প্যাশনেট মানুষ। আবেগ না থাকলে কবিতা লেখা কেন, কোন কিছুই করা সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। কারখানায় যখন আমি একজন ধাতুবিদ হিসেবে লোহা গলাচ্ছি, ব্লাস্ট ফার্নেসের ট্যাপ হোল দিয়ে ১৬৫০০ সেন্টিগ্রেডে তুমুল হইহই নিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্তরং গলানো আলো, সেইসব মুহূর্তেও আমার প্রতিটি ঘামের কণায় অনন্ত আবেগ লেগে থাকে। না থাকলে হয় না, জাস্ট সম্ভব নয়। তেমনই কবিতার প্রতি আবেগ না থাকলে ঠিকঠাক কবিতা হবে না। নির্মিত ফরমায়েশি কবিতা দেখলে আমার কবিকে লাথি মারতে ইচ্ছে করে। আমি ওই জন্যে পারতপক্ষে “প্রেম বিষয়ে দুটি কবিতা পাঠান/ ভ্রমণ বিষয়ে তিনটি…” ইত্যাদি অনুরোধকে একদম পাত্তা দিই না, ইগনোর করি। আমার লেখার অভিমুখ কেউ আগে থেকেই নির্ণয় করে দেবে ভাবলে নিজের ওপর আমার অত্যন্ত বিবমিষা আসে।
হ্যাঁ, মেধার বিষয়টা ভিন্ন। মেধা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টুল। তুমি অবশ্যই একে ব্যবহার করে নিজের কবিতার উন্নতি করতে পারো। কারণ কবিতারও একটা নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। নিয়তিনির্দিষ্ট ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতা আছে, ঐতিহ্য আছে। ওটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তুমি নজরুলের বা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ডিকশনে ২০২০তে বাংলা কবিতা লিখতে পারবে না। কিন্তু লিখতে গেলে ওই ঐতিহ্যটা তোমার জানা প্রয়োজন। এইমুহূর্তে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে গেলে তোমার জানা প্রয়োজন হাংরি, নিম, ছবিতা, প্রকল্পনা ইত্যাদি এরকম আরও অনেক ঘটে যাওয়া কবিতা আন্দোলনের কণ্ঠস্বর। তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা। মেধা ছাড়া সেটা জানা বা তাদের আত্তীকরণ সম্ভব নয়। টাইম টেস্টেড কবিতা লিখতে গেলে মেধা জরুরী। এই দুটো কম্পোনেন্টের মধ্যে কোনটাই প্রধান বা অপ্রধান নয়। দুটোই ভীষণ জরুরী।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কাব্য-জীবনে পত্র-পত্রিকা সম্পাদকদের ভূমিকা কেমন?
অমিত সরকারঃ আমি বিশ্বাস করি তীব্র মেধা ও উৎকৃষ্ট সাহিত্যরুচি ছাড়া ভালো সম্পাদক হওয়া যায় না। 'অভিমান' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ছোটবেলায় গৌতম চৌধুরীকে ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছিলাম। তখন ওনার কাছে প্রচুর কিছু শিখেছিলাম। এরপরে অনেক বন্ধুবান্ধব কবি ও সম্পাদকদের দেখেছি। ভালো সম্পাদকের আকাল তখনো ছিল, এখন আরও বেশী করে আছে। একটা ঘটনা বলি, প্রায় দশ বছর আগে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কবি প্রত্যূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ক্যানেস্তারা’ করতেন, চেনো কী না জানি না? আমাকে হঠাৎ করে একদিন আমার পত্রিকা প্রসঙ্গে কাগজের রঙ, কোয়ালিটি, পত্রিকার সাইজ এবং পাঠকের মনে তার ইমপ্যাক্ট বিষয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। আমি এগুলো জানতাম না। একজন সম্পাদকের এইরকম সব টেকনিক্যাল বিষয়ে গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হলেন আফিফ ফুয়াদ। উনি যে পরিশ্রম নিয়ে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ প্রকাশ করেন, কাছ থেকে দেখলে রক্ত জল হয়ে যাবে। উনি কবি নন, কিন্তু ভালো কবিতা চিনে নেবার জহুরীর চোখ ওনার আছে। প্রভাতদা (চৌধুরী) বা গল্পপত্রিকা ‘দেখা’র সম্পাদক দিব্যেন্দুও খুব ভালো একজন সম্পাদক। নিজে কাগজ করতে গিয়ে প্রকাশক মানবেন্দু রায়ের কাছেও সম্পাদনার বেশ কিছু শিখেছি। আমার মতে উনিও একজন খুব ভালো সম্পাদক ।
তবে বাংলাভাষায় এই মুহূর্তে প্রচুর পাঁঠা প্রজাতির সম্পাদকের রমরমা, যারা শুধু পয়সা /ক্ষমতা /সময় আছে বলেই একটা পত্রিকা প্রকাশ করে। এদের অনেকেরই ভাষা, বাংলা সিনট্যাক্স, এমনকি বানান বিষয়ে কোন জ্ঞানই নেই। ইদানিং ওয়েবজিন হয়ে এদের সংখ্যা এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়ছে। এরা হোয়াটসঅ্যাপে বা ইমেলে লেখা চায়, অভ্রতে। পেলে শুধু কপি পেস্ট মেরে দেয় ব্লগের পাতায়। শব্দ, বানান সংশোধন, বাক্য গঠনের রীতিনীতি, সবকিছুর পশ্চাৎদেশ এরা ক্রমাগত একসঙ্গে মেরে চলেছে। এবং এবিষয়ে কোন অনুতাপ বোধ পর্যন্ত এদের নেই। উদাহরণ চারপাশে খুঁজলেই পাবে।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার অনুভূতিতে মহৎ কবিতার স্বরূপ কী?
অমিত সরকারঃ এককথায় বললে টাইম টেস্টেড বা টিকে থাকা। মহৎ কবিতা একটি নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক বিন্দুতে সাহিত্য ও সময়কে কালের প্রেক্ষিতে বুঝে নিতে সাহায্য করে। মহৎ কবিতায় আমাদের চারপাশের লোভ, অস্থিরতা, রাজনীতি, ক্ষমতাপ্রহসন, ভণ্ডামি, ধর্ম, মূর্খতা, বর্বরতা, বিকেল, হতাশা, নিঃসঙ্গ অন্ধকার, বায়বীয়তা ইত্যাদি ঘুরতে ঘুরতে একটা শরীর গ্রহণ করে। এবং সেই শরীর ধীরে ধীরে পূর্ণ একটি সত্তার জন্ম ও বোধ দেয়। সেই সত্তাকে আলোড়িত করে চারপাশের ব্যস্ত মানুষদের বিচিত্র মুখ। হারিয়ে যাওয়া, বিস্ময় জাগানিয়া, সামাজিক, লোভী, পাগল, খুনী ইত্যাদি সবরকম মুখ। মহৎ কবিতায় এই মুখ বা মুখোশের সারিরা মাথার ভেতরে ঘুণপোকা হয়ে ঢুকে পড়ে, যাদের তুমি এড়াতে পারবে না। এবং তাকে গতি দেয় সময়ের ভেক্টর, তাই টাইমফ্রেম পেরিয়ে সে একাই এগিয়ে চলে কালনিরপেক্ষ ভাবে। তবে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যক্তিঅনুভূতির প্রাবল্য ছাড়া মহৎ কবিতার স্থানাঙ্ককে অবশ্যই আইসোলেট করা যায় না।
মনোতোষ আচার্যঃ কেউ কেউ বলেন-- কবিতা হল আত্ম-নির্মাণ ও আত্মজৈবনিক --এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
অমিত সরকারঃ হওয়া উচিত কিন্তু সবসময় হয় না। সারা পৃথিবীতে রোজ লক্ষ লক্ষ কবিতা নির্মাণ হয়। যে কোন বড় ঘটনার পরে ফেবু খুললেই দেখা যায় সেই বিষয়ে লাখ লাখ কবিতা। এদের মধ্যে স্ট্যাটিস্টিক্যালি ভালো কবিতা থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করি কি করে ? তবে আত্মনির্মিত কবিতা আমার পছন্দের জঁর। এটাও কারণ হতে পারে আমি ফরমায়েশী কবিতা লিখতে পারি না বলে।
মনোতোষ আচার্যঃ বাংলা ভাষায় লিটল ম্যাগাজিনের ভাণ্ডারটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এখনো বহু পত্র-পত্রিকা এখান থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তবু আপনি ২০১২ থেকে 'চর্যাপদ' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় এলেন। আপনার কী ভয় হয় না এত ম্যাগাজিনের ভিড়ে আপনার 'চর্যাপদ' হারিয়ে যেতে পারে?
অমিত সরকারঃ আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। বাংলা ভাষায় ভালো কবিতার কাগজ আমার মতে আঙুল গুনলে কুড়ি পেরোবে না। এইসব ট্র্যাশের ভিড় থেকে নিজেদের লেখার মত একটা উপযুক্ত ক্যানভাস তৈরি করতেই আমি চর্যাপদ তৈরি করি। আর চর্যাপদ নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। আমার যে কোন কাজের মত এতেও আমি কনফিডেন্ট।
মনোতোষ আচার্যঃ আশির দশকের কোন কোন কবির প্রতি আপনার অধিক মনোযোগ ছিল ?
অমিত সরকারঃ সেভাবে ভাবি না। অ্যাকচুয়ালি দশক বিভাজনে আমার কোন বিশ্বাস নেই। কখনো ছিল না। বহুবার এ নিয়ে লিখেছি, বলেছি, বিতর্ক করেছি। সমকালীনতা নিয়ে ততটা মনোযোগ দেবার কথা ভাবিনি কখনো। বরং বাংলা কবিতায় নিজের জায়গার কথাটাই ভাবতে চাই।
মনোতোষ আচার্যঃ কবিতা কেন লেখেন নাকি কবিতা আপনাকে লিখিয়ে নেয়?
অমিত সরকারঃ লিখিয়ে নেয় কথাটাই সত্যি। আমাকে অত্যাচার করে ও লিখিয়ে নেয়। আমি আমার মাথার ভেতরে কবিতার ঘুণপোকার যে ম্যালিগন্যান্ট কামড়, তা থেকে বাঁচার জন্যে ওকে ল্যাপটপে উগরে দিতে বাধ্য হই।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কিছু কিছু কবিতায় প্রাচীন সাহিত্য, পুরাণ-প্রসঙ্গ, ধর্ম, দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে উঠে এসেছে। এই পরিসরগুলোকে আপনি কীভাবে ধরেন?
অমিত সরকারঃ সচেতন ভাবে ধরি না তো। আমার কবিতায় অটোম্যাটিকালি এরা উঠে আসে। আমি একই সঙ্গে আজ ও পাঁচশো বছর বা এগারোশো বছর আগে ঘুরে বেড়াতে পারি। আমি কাহ্নর সঙ্গে চিঅন বাকল দিয়ে তৈরি বারুণী মদ পান করেছি। আবার চৈতন্যের পার্ষদ হয়ে পুরীর রাস্তায় নাচতে নাচতে হেঁটে গেছি। গৌড় থেকে শশাঙ্কর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি, শবরীর জন্যে গুঞ্জা ফলের মালা গেঁথেছি, আবার তোমাকে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করেছি। এই সময়ভ্রমণ আমার ব্যক্তিগত চরিত্র লক্ষণ, তাই আমার কবিতায় তার অনিবার্য প্রতিফলন থাকবেই।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার লেখা 'জলপরিদের শীৎকারগাথা', 'বাউলানি তোমায়', 'অপ্রেমে আজানে', 'নির্জনে সিপিয়া অ্যালবাম' পড়ার পর পাঠক ভিন্নতর কাব্যভাষার স্বাদ পাচ্ছেন 'রাতের লোকাল ট্রেনে যদি কখনো ফেরো' -- এই ভিন্নতার পেছনে আপনার সচেতন প্রয়াস কতখানি?
অমিত সরকারঃ আমার প্রত্যেকটা কবিতাবইতেই আমি কিছুটা কিছুটা পাল্টেছি। সিগনেচারটা এক রেখে আমি নিজেকে বারবার পাল্টাতে ভালোবাসি। মাঝে মাঝে আমি সচেতন ভাবেই নিজের সমস্ত কোষবিভাজনকে পাল্টে ফেলি। এই ভাবেই বেঁচে থাকতে ভালোবাসি।
মনোতোষ আচার্যঃ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কাকে মনে করেন?
অমিত সরকারঃ অবশ্যই নিজেকে।
মনোতোষ আচার্যঃ কবিতায় ব্যক্তি 'আমি'কে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া উচিত বলে মনে হয় ?
অমিত সরকারঃ পুরোপুরি। নিজের চেয়ে বেশী অন্য কিছুকে তো আমি জানতে পারি না।
মনোতোষ আচার্যঃ কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
অমিত সরকারঃ কবি তো আল্টিমেটলি একজন মানুষ, যে আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে, সকালে বাজার যায়, অফিস ফেরত বউয়ের জন্যে সিঙ্গাড়া কিনে বাড়ি ফেরে। মেয়ের কলেজের ফিজ, মায়ের ওষুধ, বাবার অপারেশনের খরচ, অফিসে বসের খিস্তি এগুলো তো তার জন্যে বরাদ্দ রয়েছেই।
এর বাইরে সে যখন লিখছে, তখন কিন্তু সে ল্যাপটপ স্ক্রিনের সামনে একজন সম্রাট। সেই মুহূর্তে কারুর কাছে তার কোন দায়বদ্ধতা নেই, দেনা নেই। সে সমাজ পাল্টানোর জন্যে কবিতা লিখুক আমি চাই না।
মনোতোষ আচার্যঃ অতি সম্প্রতি এমন কোনো তরুণ কবির বই পড়লেন যার মধ্যে সম্ভাবনার বীজ উপ্ত হয়েছে?
অমিত সরকারঃ অনেক। শুভম চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব হালদার, তন্ময় মণ্ডল, আরও অনেকে আছে। সবাইয়ের নাম মনে পড়ছে না।
মনোতোষ আচার্যঃ কবিতায় ছন্দ ব্যবহার বিষয়ে আপনার বিশেষ কোনো অভিমত আছে কী?
অমিত সরকারঃ এটা তো একটা টুল মাত্র। তোমার হাতে এটা থাকলে ভালো। না থাকলেও ক্ষতি নেই তেমন। আমি টেকনিক্যালি ছন্দটাকে ভালোই জানি। কিন্তু আমি আর ছন্দে লিখি না। আগে অনেক লিখেছি অবশ্য, তবে ওটা আর আমার পছন্দের রাস্তা নয়।
মনোতোষ আচার্যঃ সম্প্রতি বাংলা কবিতাকে ঘিরে এক 'নেক্সাস' গড়ে উঠেছে। এই নেক্সাসের পেছনে কী কোনো কায়েমি স্বার্থ নেই?
অমিত সরকারঃ সিওর আছে। দাদাকবি, দিদিকবিদের টিকে থাকতে গেলে ওই নেক্সাস অবশ্য প্রয়োজন। আর তরুণ কবি, যার নিজের হাতের ওপর কনফিডেন্স নেই, তাকে কল্কে পেতে গেলে, মানে বিভিন্ন কবি সম্মেলনের ডাক, পুরস্কার টুরস্কার, বাইরে একটু ভালো হোটেল, ফ্রি মদ খাওয়া, এইসব পেতে গেলেও ওই নেক্সাস লাগে। এইসবের জন্যেই এই আবর্জনাগুলো তৈরি হয়।
মনোতোষ আচার্যঃ জীবনে প্রথম লেখা গল্প 'চারণভূমি' ২০১৬ সালে 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হতেই প্রচুর পাঠকের ভালোবাসা, সিনিয়র গল্পকারদের শুভেচ্ছা , উৎসাহ পেলেন। এত ভালোবাসার রহস্য কী?
অমিত সরকারঃ এটা আমি সঠিক জানি না। বোধহয় নিজের যাপন অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যের সঙ্গে ঠিকঠাক ব্লেন্ড করতে পেরেছিলাম বলে । মনে হয় ককটেলটা ঠিক ছিল।
মনোতোষ আচার্যঃ গল্প লিখতে এলেন কার প্রেরণায়?
অমিত সরকারঃ ম্যাডাম, মানে অরণ্যা সরকারের। আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম জীবনে কোনোদিন কবিতা বা কবিতা বিষয়ক গদ্য ছাড়া আর কিছু লিখবো না। একমাত্র ওর জোরাজোরির ফলেই গল্পের সীমান্তরেখায় আমার অনুপ্রবেশ। আর বউয়ের সঙ্গে কোন শালা কবে তর্কে জিতেছে ?
মনোতোষ আচার্যঃ লং ড্রাইভিং এর পাশাপাশি খোঁজ পেয়েছি আপনার আরও এক নেশা ফোটোগ্রাফির বিষয়ে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কারও পেয়েছেন। এই ব্যাপারে যদি কিছু বলেন?
অমিত সরকারঃ আমার ছবি তোলার নেশা বহু বছর ধরে। ভ্রমণের সঙ্গে তো এটা জড়িয়েই থাকে। আমি ফর্মালি ফটোগ্রাফির কোর্সও করেছি। তবে বেশ কয়েক বছর আগে কিছু সঙ্গী ফটোগ্রাফারের পাল্লায় পড়ে, ইংল্যান্ডে একটি কম্পিটিশনে যোগ দিই, এবং খানিকটা ভালো রকম অর্থমূল্যেই পুরস্কৃত হই। তারপর দরজাটা খুলে যায়। এখনও অবধি আটটা দেশ থেকে ছবির জন্যে স্বীকৃতি পেয়েছি। এদেশেও অনেকগুলো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি অবশ্য। অর্থ ও সম্মান দুটোই যখন আসছে ক্ষতি কী ?
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কী মনে হয় সরকারি/ বেসরকারি পুরস্কার একজন কবির জীবনে অত্যন্ত জরুরি?
অমিত সরকারঃ দেখো, ছবির অ্যাওয়ার্ডের সঙ্গে সাধারণত একটা অর্থমুল্য জড়িয়েই থাকে। ওটাই একটা বিরাট মোটিভেশন। প্লাস ছবি বিক্রিও হয়ে যায় অনেক সহজে। কিন্তু লেখালিখির সঙ্গে এখানে তো একদমই অর্থ জড়িয়ে নেই। তাই মঞ্চে ওই স্বীকৃতিটুকু পাওয়া গেলেও একটা রেকগনিশনের ফিল আসে। মনে হয় লেখার জন্যে আমার এই শ্রমটার একটা স্বীকৃতি পাঠকেরা দিল। তাই পুরস্কারটা জরুরী। এটা কনফিডেন্স বুস্ট আপ করে।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনারও কি প্রশ্ন জাগে চারিদিকে 'বহুপ্রসূ অথচ বন্ধ্যা' কলমের এত ভিড় কেন?
অমিত সরকারঃ সঠিক এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার নিজস্ব মত হচ্ছে, ইদানীং একটা মেধার ডেকাডেন্স কাজ করছে। লেখা প্রকাশ ই-মিডিয়া আর ফেসবুকের কল্যাণে এত সহজ হয়ে গেছে, যে মাঠে নামার আগে প্রয়োজনীয় অনুশীলনটাই কেউ করছে না। তুমি এদের কাউকে চা খেতে খেতে হঠাৎ জিজ্ঞেস কর, উৎপল কুমার বসু, দেবদাস আচার্য, বা শম্ভু রক্ষিতের কবিতা পড়েছে কী না ? পড়লে কোন কবিতা বা বইটা পড়েছে ? কেন ভালো লেগেছে ? উত্তরটা পেয়ে যাবে বলে মনে হয়। এঁদের নামটা শুধু উদাহরণ হিসেবেই তুললাম। প্রস্তুতি না থাকলে কিছুতেই সফল হওয়া যায় না বন্ধু।
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার পরবর্তী সময়ের সাহিত্যসেবীদের প্রতি আপনার বার্তাটি ঠিক কেমন?
অমিত সরকারঃ ভাই, আমি প্রফেটিক হয়ে যেতে চাই না। আমার লড়াইটা প্রতিদিন আমাকেই লড়তে হয়। তাদেরটাও তাদেরকে। আমি উপদেশ দেবার জায়গায় একদম নেই।
মনোতোষ আচার্যঃ ধন্যবাদ অমিতদা, বইতরণী'র পাঠকদের জন্য এতটা সময় দেওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে সুযোগ পেলে আবার কথা হবে। এখন আপাতত এই পর্যন্ত...
অমিত সরকারঃ সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া। শুভেচ্ছা রইলো।
বেশ খোলামেলা সাক্ষাৎকা। অকপট উচ্চার।
ReplyDeleteবেশ খোলামেলা সাক্ষাৎকা। অকপটউচ্চার।
ReplyDeleteবেশ ভালো লেগেছে। প্রতিটি প্রশ্ন খুব ভালো।
ReplyDeleteসুন্দর সাক্ষাৎকার। অমিত সরকারকে আন্তরিকভাবে জানলাম। সাক্ষাৎকারটি নেয়ার জন্যে মনোতোষ আচার্যকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteখুব সুন্দর সাক্ষাত্কার।
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা
ReplyDelete