Wednesday, September 16, 2020

কথামুখ






 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য হারাতে বসেছে জীববৈচিত্র্য। কিছুদিন আগেও বনে-বাদাড়ে যেসব পশুপাখি-বৃক্ষের প্রাচুর্য ছিলো এখন সেগুলোর ছিটেফোঁটাও নেই। প্রকৃতির অপার সৃষ্টি এই জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যই সারা বিশ্বে এই দিবসটি বিশেষভাবে পালিত হয়ে থাকে।


অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় তথা সুস্থতার সঙ্গে জীবন ধারণের জন্যই প্রয়োজন সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের। মানুষসহ সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য একান্ত অপরিহার্য। আর এই ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বার্থে জীববৈচিত্র্যে রক্ষা করা আবশ্যক। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্য প্রয়োজন। শুধু কয়েকটি আলোচিত প্রজাতি রক্ষা করলেই জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয় না। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সব প্রকারের জীব প্রজাতির ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দেয়া। আমেরিকার জীববিজ্ঞানী ই.এ. নরসে (E.A.Norse) এবং তার সহযোগীদের সূত্র অনুযায়ী জৈববৈচিত্র্য হলো জল, স্থল সকল জায়গায় সকল পরিবেশে থাকা সকল ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্রতা। পৃথিবীর ১০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ অংশতেই ৫০ মিলিয়ন প্রজাতির বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস। আমাদের দেশেও বৃক্ষ প্রজাতি এবং প্রাণিকুলের সবিশেষ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে অনেক গাছপালা ও লতাগুল্ম এবং প্রাণিবৈচিত্র্য আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। কিছু কিছু আবার বিছুপ্ত হয়েও গেছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের অবৈধ উপায়ে গাছপালা ও বন্যপ্রাণী নিধন, নদ-নদী ও জলাশয় ভরাট জীববৈচিত্র্যকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।


জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কারণে সারা পৃথিবীতে এখন জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। আমাদের দেশের সুন্দরবন উপকূলের বিশাল এলাকায় জীববৈচিত্র্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ দিকগুলো লক্ষ করা যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর আবাসস্থল হচ্ছে সংকুচিত। পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য বাঁচাতে এবং এর টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণ, দর্শন, দিকনির্দেশনা তৈরির উদ্যোগে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এবং চুক্তিতে দেড় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। আমাদের নিজের জন্য হলেও এই জীববৈচিত্র্যগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।

পরিবেশ বিজ্ঞানের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানব সমাজের উপকারে আসে। বিশ্বকে সব রাষ্ট্রের মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখতে পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রতিপালন আবশ্যক। দেশের কৃষি অগ্রযাত্রাকে সুষ্ঠুভাবে ত্বরান্বিত করতে জীববৈচিত্র্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ভারত একটি বিপুল জনসংখ্যার দেশ। আমাদের এই বিপুল জনসংখ্যার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব আছে। সে হিসেবে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের দেশের মানুষকে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সকল পেশার মানুষকে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সজাগ করতে হবে। আর তা না করতে পারলে এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদেরই বহন করতে হবে।


সমগ্র প্রাণিকুলকে বেঁচে থাকতে হলে একটা সার্কেলের প্রয়োজন। সেই সার্কেলটিই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। অর্থাৎ এক প্রজাতিকে টিকে থাকতে হলে অন্য প্রজাতির ওপর নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের মূল বিষয়। 

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা " পরিচয়" শিরোনামে যে কবিতাটি পড়েছিলাম তার বিষয়বস্তু মোটামুটি এই রকম, উলঙ্গ ছোট ভাইকে নদীর পাড়ে বসিয়ে এক গ্ৰাম্য মেয়ে নদীর জলে ঘটি মাজছে। ভাইয়ের অদূরে এক ছাগলছানা চরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ সেই ছাগলছানা বাচ্চা ছেলেটির কাছে এসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে ডেকে উঠতেই ছেলেটি ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। দিদি ছুটে এসে এক কোলে ভাইকে,আর অন্য কোলে ছাগলছানাকে তুলে নিতে কবির মন্তব্য-- " পথশিশু, নরশিশু-- দিদি মাঝে পড়ে, দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয়-ডোরে।" এই কবিতার মধ্য দিয়ে মানবশিশু ও ছাগশিশুর মৈত্রী বন্ধনের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা গ্ৰামবাংলার কোন বিরল ঘটনা নয়। সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে গৃহপালিত জীবজন্তুর সম্পর্কের ভিত্তি শুধুই বস্তুগত চাহিদা নয়, ভালোবাসারও বটে। জীববৈচিত্র্য প্রতি সচেতন হতে গেলে এই মৈত্রীর বন্ধনটা জরুরি।



সম্পাদকঃ-  অরিজিৎ চক্রবর্তী


জার্নাল - দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


 বনে বাদাড়েঃ দাঁদড়ের সাহিত্যসাধক
---------------------------------------------

পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা থানার অন্তর্গত একটি প্রত্নস্থল। লৌলাড়া। গ্রামে যে তিনটি প্রাচীন জৈন মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, তাদের শিল্পকলা দেখে অনুমান করা হয় যে, সেগুলি নবম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। 
একটি আদিনাথ। ৮৪ সেন্টিমিটার x ৫০ সেন্টিমিটার মাপের পঞ্চরথ শৈলীর মূর্তিটির শিরোদেশ ত্রিছত্র শোভিত ও পশ্চাতে প্রভাবলী। মূর্তির দুই পাশে মালা হাতে অভ্যর্থকদের মূর্তি, দুজন পরিকরদের মূর্তি এবং ছটি সারিতে দ্বিতীর্থিকা মূর্তির ছটি করে সারি অবস্থিত।
আরেকটি অপরিচিত মূর্তি। ৭৭ সেন্টিমিটার x ৮৭ সেন্টিমিটার মাপের ভগ্নছত্র মূর্তির পশ্চাতে প্রভাবলী। মূর্তির দুই পাশে মালা হাতে অভ্যর্থকদের মূর্তি, পার্শ্বদেবতা ও জ্যোতিষ্কদেবগণের মূর্তি বর্তমান। 
আরেকটিও অপরিচিত। ৬৪ সেন্টিমিটার x ৪১ সেন্টিমিটার মাপের ভগ্নছত্র মূর্তি। বিশ্বকমলের ওপর সমভঙ্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান। 
এক গ্রীষ্মের দুপুরে দাঁদড় আশ্রমে ঘুরে ঘুরে মূর্তি, কথকথা, ইতিহাস নিয়ে কথা হচ্ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রায় ছ ফুট লম্বা। ঋজু, মেদহীন, মেরুদন্ড সোজা করে চলা মানুষটিকে দেখে বোঝার যো নেই যে তিনি সত্তোরোরধ।
পুরুলিয়ার দুপুর মানে লু। কিন্তু গাছগাছালির ঘন আচ্ছাদনে এক শীতলতার পরশ। মনেও।
 সেই প্রথম আলাপ। যেন মহিমামণ্ডিত হয় এই উঁকি দেয়া, রোদের। গাছের ফাঁকে। যার আভা এসে লাগে শাল, মহুল, পলাশে। ডেকে ওঠে ময়না, খঞ্জনা।  দাঁদড় গোপাল আশ্রম প্রাঙ্গণে। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী বিরজানন্দ ভারতী। ক্ষ্যাপা মনোহর ঠাকুর নামেই এলাকায় জানত লোকে। ওনার আগে নাকি আরো ১০৭ জন সাধক এই একই স্থানে সাধনা করেছিলেন। 
বলেন কি? ১০৮ জন!
গোপাল বাবা বহু বছর সাধনা করেন এখানে। বসেন পঞ্চমুণ্ডির আসনে। সাধনার ফলে স্বয়ং বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিয়ে পদচিহ্ন রেখে যান। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকাল অবশ্য ১৯৭২। বললেন উনি।
প্রানান্তকর পরিশ্রম করে একটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ সম্পাদনা করেন সুভাষ বাবু। দাঁদড়। জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যায় বিজ্ঞাপন যোগাড়ে। কিন্তু খামতি নেই। তাগাদা দিয়ে সেরা লেখাটি লিখিয়ে নিতে জুড়ি মেলা ভার আমার সম্পাদকের। পুজো সংখ্যার জন্য প্রচ্ছদ চাই। একটা বড় লেখাও। আমার পুরুলিয়ার অফিসে এক কাপ চা খেয়ে ওঠার সময় বলে যেতেন। 
যুদ্ধ মনে করেন না জীবনটাকে। যাপন করেন। অকুন্ঠ ভালোবাসাও ঝোলা ভর্তি হয়ে থাকে। ওনার ভাগের ভালোবাসা অন্য কেই বা নেবে। মহাশ্বেতা দেবী চিঠি লিখে পাঠান। নতুন কাগজ, তার সামনে সম্ভাবনা অনেক। বিশেষ করে এই জেলায়, যেখানে দাঁদড় পত্রিকার খুব দরকার আছে।  একই সঙ্গে জল-জমি-অরণ্য-পশুপাখি এসব রক্ষা করবার প্রয়োজন সম্বন্ধে জনচেতনা জাগাবার প্রয়াসও এই পত্রিকা করুক। সুভাষ নিশ্চয় এ বিষয়ে মনোযোগী হবে।
লাগাতার এই বানী পাথেয় করেই চলেছেন লোকটি। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল স্বীকৃতি পান। মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়ায় এসে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সাহিত্যসেবীকে। মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে সাক্ষী থাকি আমি। 
সাহিত্যসেবীকে বলেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত খাদে পড়ে যে রাখালের বাঁশির ধ্বনি থেমে থাকে না, শীতের ভোরের দূর্বাঘাসের ঠোঁটে একবিন্দু শিশিরের প্রতিচ্ছবি, জ্যোৎস্না রাত্রে বসুন্ধরাকে রহস্যময়ী নারীর রূপে কল্পনা করা, ভাঙ্গা কাঁসর ঘন্টা থেকে বেছে ওঠা পুরনো জীবনের ছন্দ, নীল আকাশের চোখের চাওয়ার অব্যক্ত আকুলতা যাদের ভাষায় কোনদিন প্রকাশ করা যাবে না, তাই সাহিত্য। সংলগ্ন বা অসংলগ্ন কিছু কথা লিখে যাই। হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি। যে হাসি রসসিক্ত। একান্ত অন্তরের।  
দাঁদড়ে সাধক বোধহয় ১০৯ জন। একজন এখনও সাধনারত। সাহিত্যব্রতী। ওনার ধ্যানের চেয়ে কখনো বেশি মূল্য যেন না-পায় কোনো অবাস্তবতা। মানুষই যেন হয় প্রকৃত সাধক। পাখির কণ্ঠে যেন ভাসে ওই গান, মানুষের।

নিবন্ধ - অভিজিৎ দাশগুপ্ত

সুকুমারী ভট্টাচার্য

 সমাজতন্ত্রের ধারা ও সুকুমারী ভট্টাচার্য 
-----------------------------------------------------

অভিজিৎ দাশগুপ্ত


" মুক্তি , মুক্তি এখন ---                                           ক্ষোভ আর ক্রোধের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে  আসছি    আমরা , 
মুক্তি এখন । "

পাশ্চাত্যে নারীর ভোটাধিকারের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে নারী আন্দোলনের জন্য বেটি ফ্রিডান একটি সংগীত রচনা করেন । এটি তার প্রথম অংশ। বর্তমান সময়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আন্দোলনকারী নারী ধীরে ধীরে তার নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করেছে সোচ্চারে। 


কিন্তু কেন এই অবস্থা ? তাহলে আমাদের চলে যেতে হবে অতীতে । অতীত অর্থে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে সমাজে । যে সমাজে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে পড়ছে কৃষি , ধাতু ( ব্রোঞ্জ) এবং উন্নত জীবন পদ্ধতি। সুকুমারী ভট্টাচার্যর চিন্তার ক্ষুধা বীজ ধরা আছে এমন- ই কিছুর বিপরীতে । তাই মহাকাব্য , পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে তিনি যখন আমাদের পুরোনো অভ্যাসকে ত্যাগ করে নতুন পথের হদিস দেন , তখন সেই বহুপ্রসবী ভাবনা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে অতীতে পৃথিবীর সব জায়গায় নারীদের অবস্থা একই ছিল ছিল । মধ্যযুগ পর্যন্ত তার কোনো প্রতিবাদ তৈরি হয়নি হয়নি প্রতিবাদ তৈরি হয়নি হয়নি । নারী সেদিন পর্যন্ত ছিলেন ----

"বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ
পতিসেবা গুরৌবাসঃ গৃহার্থোহগ্নি পরিক্রিয়া।। "
                                          মনুস্মৃতি ২ । ৬৬ , ৬৮
( স্ত্রীলোকের পক্ষে বিবাহই  বৈদিক সংস্কার  ; তাহার পক্ষে স্বামীসেবাই গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম্ম করাই তাহার যজ্ঞ।) 


ব্রেটি ফ্রিডান ,  সিমন দ্য বোভোয়া , সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখেরা  এই  ' নামহীন সমস্যা 'র বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়েছিলেন আজীবন। ফ্রিডান রচিত ' দি ফেমিনিন মিস্টিক '  বইটিকে মারিয়া ম্যান্ স ট্রিগারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন । আমেরিকার গৃহবধূদের প্রচুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের প্রচুর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের অতৃপ্তির কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি । জীবন যে কতখানি শূন্য হতে পারে; নারীর  একক অস্তিত্বের ক্ষেত্রে তা প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল । ফ্রিডান তাঁর বইতে নারী কে আবিষ্কার করেছেন স্বামীকে আনন্দে রাখার মধ্যে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার মধ্যে আর অবশ্যই ভাল রান্না বিশেষ করে মুরগির মাংস তৈরির মধ্যে। 


সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রাচীন সাহিত্যের একজন গবেষক-  পাঠক । চিন্তা - উদ্দীপক তাঁর লেখাগুলি আমাদের অতীতকে সঞ্জীবিত করে নতুন দর্শনে । ঋক্ বেদের যুগ ও তার পরের সময়ে নারী নারী কীভাবে প্রান্তিক হয়ে যায় তার বিশ্লেষণে তিনি ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যাযাবর পশুচারী আর্যরা উত্তর ভারতে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আর্যাবর্তে নতুন এক জীবনধারার প্রচলন হয় । এক জায়গায় স্থায়ী হবার পর পর স্থায়ী হবার পর পর হবার পর পূর্বের গোষ্ঠী, কৌম ইত্যাদি ভেঙে গিয়ে কুল বা পরিবারের জন্ম হয়। এ পরিবার যৌথ যৌথ । সমাজের বিবর্তনকে সঙ্গে নিয়ে অর্থনীতিও ধীরে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল যাচ্ছিল ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল । যে কৃষি একদিন একদিন নারীদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল , সেখানে তাদের অধিকারও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে । " উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশ ক্রমেই  কমে যাচ্ছিল , যদিও গৃহকর্মে তার পরিশ্রম ও দায়িত্ব যথেষ্টই ছিল তবু তাকে ' ভার্যা ' অর্থাৎ অন্যের দ্বারা প্রতিপালিত এই সংজ্ঞা দেওয়া দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে ' ভৃত্য '  আর   'ভার্যা ' শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ একই : যাকে ভরণ করতে হয় । স্ত্রী স্বয়ং অন্ন উৎপাদন করে না তাই সে ভরণীয়া ---- একথা  বলছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। এ হল পরিহাসের চূড়ান্ত । যে নারী একদিন গাছের জন্ম কৌশল , বীজের ধর্ম খুঁজে পেয়েছিল --- যার কৌশল প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদনে অংশ নিত ; তাকেই শেষ পর্যন্ত ' ভরণীয় ' হয়ে থাকতে হবে চিরটাকাল। 


সমগ্র বৈদিক সাহিত্যে একমাত্র ঋক্ বেদেই নারীকে আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় । যদিও ঋগ্বেদ রচনার রচনার কয়েকটি স্তর আছে । তার প্রথম দিককার মন্ত্রগুলিতেই নারীর স্বাধীনচেতা ভাবটি বর্ণিত । যেমন --- " যমযমী সূক্তে (১০/১০) ভাই বোনের ও নাভানেদিষ্ঠ সূক্তে (১০/৬১/৫-৭)  পিতা পুত্রীর আসক্তির কথা আছে , ...। ...ঋক্ বেদে সহমরণে,পরবর্তীকালে যাকে সতীদাহ বলা হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ নেই ;  বিধবা বেঁচেই থাকতো, কখন - বা দেওরের সঙ্গে বিয়ে হতো তার, আর কখন- বা আর বিয়েই হতো না না হতো না না । "
                                ( ' বৈদিক সমাজে নারীর স্থান ') 


ঋক্ বেদের যুগ পার হলেই একটা বিরাট পরিবর্তন চোখে পড়ে । তখন গৃহকর্ম ভিন্ন আর কোনো বৃত্তি নেই তার নেই তার বৃত্তি নেই তার নেই তার । প্রতিবাদ অথবা নিজের ইচ্ছার কথা জানাতে পারবে না সে । যেমন --- ' বিবাহের সব কটি মন্ত্রেই উচ্চারণ করে বলা হয় স্ত্রী যেন চিন্তায় ও কাজে স্বামীর অনুবর্তিনী হয় , স্বামীর চিত্তের অনুগামিনী অনুগামিনী হয়;  কোথাও বলা নেই , স্ত্রীরও চিত্ত বলে একটা কিছু আছে এবং স্বামীকে তার প্রতি অনুকূল হতে হবে হতে হতে হবে । ' এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্য ভবিষ্যৎ চিন্তার বৃত্তটিকে  চিহ্নিত করেছেন । তাঁর স্পষ্ট অভিমত --- " পরবর্তী সাহিত্য যে নারীকে ভোগ্যবস্তু ও পণ্যদ্রব্য বলতে সাহস করেছে তার জোরটা যুগিয়েছে বৈদিক সাহিত্যই। ক্রমেই অবশ্য ঐ ভোগ্যত্ব ও  পণ্যত্বেই জোর দেওয়া বেড়েছে । " এমনকি রামায়ণে তার ছাপ পড়েছে রামের কথায়। অশোকবনে কাটিয়ে আসা সীতাকে তিনি ' ভোগ ' করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। 


নিরঙ্কুশ শাসন আর শোষণ মানুষ কোনদিনই মেনে নেয় নি নি । অন্যান্য সভ্যতাতেও একই ঘটনা। তাই ' ... নারী এই শতাব্দীতেই  প্রথম অধিকার সচেতন হয়েছে , আগে সে অত্যাচারিতা বন্দিনীই ছিল । ' বেটি ফ্রিডান,সিমন দ্য বোভায়া, ম্যারি স্টোপস্ , শার্লোট উলফ্ প্রমুখেরা এগিয়ে এসেছেন নারীর ভবিষ্যৎ জীবনকে সুরক্ষিত করতে। 


বেদ গবেষণায় ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছিলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য । আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী হয়েও প্রতিবাদী ভূমিকাটি বিস্মৃত হননি কোনোদিনই । ২০০৯ নন্দীগ্রামের ঘটনা তার প্রমাণ ।  একদিকে নারী আর অন্যদিকে নিচুতলার মানুষ --- এই দুই ছিল তাঁর জগৎ। 

আমাদের আক্ষেপ একজন মেধা পাটেকর, একজন রেখা কালিন্দী , একজন গুলশান পর্ভিন, একজন শর্মিলা চানু বর্তমানে থাকা সত্বেও নারীর অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে হয় আমৃত্যু। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্য দিয়ে সেই পথকেই খুলে দিয়েছিলেন বহুদিন আগে। 

তথ্যসূত্রঃ ১.প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য --- 
                   সুকুমারী ভট্টাচার্য। 
                 ২. পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন --- ঊর্মি
                     রহমান। 
                 ৩. স্বদেশচর্চা লোক। নানারূপে নারী ১:
                      সম্পাদক --- প্রণব সরকার।

নিবন্ধ - উজ্জ্বল মাজী




ভাদু : একটি বিস্মৃত লোকগান 

                            





        সেদিন বিনোদনের অপর নাম মোবাইল ছিল না । দেবদেবীর আবাহন বা বিসর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল না শব্দদানব ডিজে । সেদিন কার্টুনের টম জেরিও ছিল না । তাই মা গান গেয়ে বা ছড়া কেটে ছেলেমেয়েকে  খাওয়াতো, ঘুম পাড়াতো । সেদিন টিভি সিরিয়ালের কূটকচালির বদলে, গাঁয়ের মেয়েবউদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল পাখির কাকলির মতো শান্ত, সুমিষ্ট সুরের গান । গান ছিল তাদের মান অভিমান , হাসি কান্নার দোসর । সেদিন পুরুষেরা নদীতে মাছ ধরে গিয়ে, সাগরে নৌকা বাইতে গিয়ে এমনকি ছাদ পিটাই করতে করতে গান গাইত , মেয়ে বউরা ঢেকিতে পাড় দিত,  ক্ষেতে ধান লাগাত গান গেয়ে -

“কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদি ঘরে কি কর

হাতের জালি লয়ে কাঁখে সুখসায়রে মাছ ধর । 

মাছ ধরণে গেলে ভাদু ধানের গুছি ভেঙো না

একগুছি ধান ভাঙলে পরে পাঁচশিকা জরিমানা ।।’’

এভাবেই অধিকাংশ মেয়েলি  ব্রতের মতো ভাদু গানেও জায়গা করে নিয়েছিল ছড়া , কখনো বা গান । এই গানগুলি সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতার দলিল ।

      অবিভক্ত মানভূমের অন্যতম লোকপার্বণ ভাদু । আগে পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদ্র সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিটি সন্ধ্যায় গাঁয়ের অধিকাংশ পরিবারে ভাদুর অর্চনা  চলত । তাই মানুষের সুখে দুঃখে আহারে নৈবেদ্যে জড়িয়ে গিয়েছিল ভাদুগান । বাতাসে কান পাতলেই শোনা যেত ভাদুকে নিয়ে গড়ে ওঠা নানান কিংবদন্তী । প্রচলিত লোককথা অনুসারে , ভাদু কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিংদেও এর প্রজাদরদী কৃষ্ণপ্রাণা কন্যা । পাশের লাড়া  গ্রামের এক চাষীর ছেলের সঙ্গে ভাদু প্রণয়পাশে জড়িয়ে পড়লেও সে প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ।বিবাহের রাতে তাঁর প্রেমিক খুন হলে যন্ত্রণাবিধুরা ভাদু আত্মহত্যা করে। ভাদুর স্মৃতিকে অমলিন করে রাখতে কাশীপুরের রাজপরিবার ভাদুগানের প্রচলন করে । কিন্তু কাশীপুরের রাজপুরোহিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ‘পঞ্চকোটের ইতিহাস’ গ্রন্থে রাজা নীলমণি সিংদেও এর তিনজন রানীর গর্ভে দশজন পুত্রসন্তানের কথা উল্লেখ করলেও রাজার কোনো কন্যা সন্তানের উল্লেখ করেননি । তাছাড়া ভাদু প্রধানত আনন্দ উৎসব । ভাদ্রসংক্রান্তিতে ভাদুর জাগরণের দিনে খাজা গজা জিলিপিসহ নানান মিষ্টান্নের প্রাচুর্য দেখেই বোঝা যায় এখানে শোকের চিহ্নমাত্র নেই । ভাদুগানেও দেখা যায় আনন্দ হুল্লোড় -         

                             “বলি ও ললিতে ! চল না সবে যাব ভাদু দেখিতে ।

তোরা তাড়াতাড়ি গয়না শাড়ি পরে চল মোদের সাথে ।।

খোঁপা ঝুঁটি বাঁধবি আঁটি গো, ঝুমকা নিবি সিঁথিতে

আবার পায়ের চটি ভুলিস না নিতে লো নইলে ভুগবি কুলআঁটিতে ।

জয়বাংলার হিড়িক এল লো, চশমা নিবি  চোখেতে ।”

      আনুমানিক পঞ্চাশ বছর বয়স্কা কাজল গরাঁইয়ের কিশোরীকালের খাতা থেকে পাওয়া উপরোক্ত গানে দেখা যায় ভাদু পার্বণ মানেই বাহারি সাজপোষাক পরে বান্ধবীদের সঙ্গে  ভাদু দেখতে বেরিয়ে গান আর আনন্দশ্রোতে ভেসে যাওয়া -

“ ভাদু দরশনে এসেছ সবে আমাদের ভাগ্যগুণে ।

এলে যদি দয়া করে গো বাহিরে কেনে ?

এসো ঘরের ভিতরেতে গো , বস গো এই আসনে ।।

শুধু শুধু ভাদু দেখে ফিরে যাবে কেমনে !

ভাদুর গান শোনাব গান শুনিব আইন আছে এইখানে ।।”


       আবার আশির গণ্ডী পেরোনো কাজল গঁরাইয়ের শাশুড়ি সিমলাপাল থানার পুখুরিয়া পোস্টঅফিসের অন্তর্গত পচাপাথর গ্রামের কালিদাসী গঁরাই স্মৃতি হাতড়ে তুলে এনেছেন যে ভাদুগান সেখানে ভাদু যেন রাধা হয়ে যায় –

“ আখবাড়িতে ঢাক বাইজছে গো ,আইসছে আমার ভাদুধন

চেয়ে দেখ রে  ব্রজের বালক  কতদূরে বৃন্দাবন !

বৃন্দাবনের ভাদু তুমি বৃন্দাবনে কি কর

কে বা তোমার মাতা পিতা কার বা তুমি আশ কর । ”

         লক্ষীসাগরের বাউরিসোল গ্রামের স্বপন পাইনের কাছ থেকে পাওয়া রেণুকা পাইনের ভাদুগানগুলিতে ভাদুর রূপবর্ণনার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে আগমনি গানের সুর – 

“ ভাদু আমার সনার যাদু সাত রাজার ধন মণি গো ।

বছর পরে এলে ভাদু যেন রূপের খনি গো ।।

ও গঙ্গাজল যাও ছুটে যাও নিয়ে এস সিংহাসন

তাতে বসিয়ে ভাদুধনকে কেশ দিয়ে মোছাব চরণ ।।

জামাই বড় আদরের ধন জামাই কেন আসে না !

বল বল ব্যাপার কী লো ভালো কি সে বাসে না ?

পিরিত চাবুক দিয়ে ভাদু যাবে ঘোড়ায় চড়ে গো ।

দেখব কেমন রাজার ব্যাটা ! আনব তারে ধরে গো ।।

কোকিল ডাকে বকুল শাখে , পায়রা  ডাকে বাকুড়কুম ।

বেলা আটটা বেজে গেল ভাঙল না ত ভাদুর ঘুম ।।

উঠ উঠ উঠ ভাদু নয়ন মেলে বারেক চাও । 

আজ তিনদিন খাও না কিছু উঠে কিছু মুখে দাও ।।

নইতন পুকুরের পাড়ে পায়রা গুমগুম করে গো ।

পায়রা লয় মা , পাখি লয় মা , ভাদু খেলা করে গো ।।

তারই পাশে পদ্মপুকুর জল টলমল করে গো ।

যেও না যেও বা ভাদু পিছলে পড়ে যাবে গো ।।

ভাদু আমার সনার যাদু সাত রাজার ধন মণি গো ।

বছর পরে এলে ভাদু যেন রূপের খনি গো ।।”

বৈষ্ণব কবির লেখা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার মতো ভাদুর বাল্যলীলা ফুটে উঠেছে স্বভাবকবির উপরোক্ত ছত্রগুলিতে । হয়তো প্রথাগত ছন্দে সেরকম দক্ষতা না থাকার কারণে উপরোক্ত গীতিকার বারংবার ‘গো’ ধুয়াপদটি ব্যবহার করেছেন ।

       এই তিরিশ দিনে আদরের ভাদু আরাধনা করতে যাবার সময় গাঁয়ের মেয়ে বউরা ভাদুর জন্য নিয়ে যেত খাজা গজা জিলিপি , এমনকি চিনি দিয়ে দুধের সর পর্যন্ত । এতদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে ভাদু শেষঅব্দি আর দেবী থাকে না , বরং  ঘরের মেয়ে হয়ে যায় । তাই ভাদুকে মুড়ি, কলাই ভাজা দিতেও মা মেয়েদের কুণ্ঠা হয় না ।  এমনকি তাঁরা অনায়াসে ভাদুকে মুড়ি ভাজতেও বসিয়ে দিতে পারে ‘আমার ভাদু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝন্ ঝন্ করে লো’। ভাদ্রমাসের শেষদিন ভাদুকে বিদায় দিতে গিয়ে তাই দুঃখের মেঘ ঘনিয়ে আসে মায়ের মনে, ভাদুর সঙ্গী সাথীদের চোখে জলের ধারা বাঁধ মানে না। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া রঘুনাথপুরের গোবিন্দপুর গ্রামের জারুবালা মাজী স্মৃতি থেকে উদ্ধার করলেন এরকমই একটি গান -  

“  তিরিশ দিন যে রাইখ্লম ভাদু মা বই্লে আর ডাই্কলে না

যাবার সময় রগড় ধর মাকে ছাড়া যাব না ।

যাই্ছ যাই্ছ যাই্ছ ভাদু পিছু দিকে তাকাও না

পিছু দিকে সতীন আছে পান দিলে পান খাইও না ।

যাই্ছ যাই্ছ যাই্ছ ভাদু দু’পাশাড়ি ভাই্ল না

নয়নলালায় জল পালাই্ছে সংতীর মন ভাইব না ।।”    

       আবার রঘুনাথপুর শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের ভাদুপালনকারিণী সত্তর বছর পেরোনো কণিকা মাজীর খাতা থেকে পাওয়া গানগুলির বিষয়বস্তু রামায়ণ, মহাভারত, শিব পুরাণের বিভিন্ন পালা । তিনি এই গানগুলিকে বলেছেন ‘ভারতভাঙা গান’ । অর্থাৎ মহাভারত ভেঙে গ্রামের কোনো অর্ধশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত কবির কলমে এই গানগুলি লেখা হয়েছিল ।তাঁর খাতা থেকে পাওয়া গানগুলি হল ১) প্রহ্লাদচরিত্র বা হিরণ্যকশিপু বধ ২ ) শিবের  ধ্যানভঙ্গ ৩) রাবণের যুদ্ধে গমণ ও লক্ষণের শক্তিশেল 8) গঙ্গার উৎপত্তি ও ভগীরথের জন্ম ৫ ) দাতা কর্ণ প্রভৃতি । প্রসঙ্গত বলে রাখি , মহাভারত বা রামায়ণ নিয়ে লেখা এইসব গানগুলি বনেদী বাড়ির ভাদুমণ্ডপে সুর করে গাওয়া হত । আর কথা না বাড়িয়ে আমি বরং ‘দাতাকর্ণ’ থেকে সামান্য অংশ তুলে দিই –  

“একদিন বাসুদেব ভাবিল অন্তরে ।

কর্ণ সে কেমন দাতা বুঝিব তাহারে ।।

যে যাহা মাগে কর্ণ তাহা দেয় দান ।

সবে বলে দাতা নাই কর্ণের সমান ।।

হরি বলেন যাব আমি কর্ণের নিকটে 

বুঝিব সে কর্ণ বীর কেমন দাতা বটে ।

এই কথা মনে করি প্রভু নারায়ণ

মায়া করি হইল এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ।।’’ 

        অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ভাদ্রের অলস সন্ধ্যায় কণিকাদেবী এখন টিভি সিরিয়ালে মজে থাকেন । ভাদুগান করেন না । কালিদাসী গঁরাইয়ের নাতবউ, কাজল গঁরাইয়ের পুত্রবধু ঝুমা গঁরাইও বর্তমানে ছেলেমেয়ের অক্ষরশিক্ষায় কাজে মগ্ন থাকেন বেশিরভাগ সময় , অবসর সময়ে মোবাইলে গান শোনেন । কখনো জারুবালাদেবী নাতনী বা নাতজামাইয়ের আবদার মেটাতে স্মৃতির পাতা হাতড়ে দু এক কলি গাইতে চেষ্টা করলেও ভাদু গানে আর মুখর হয় না পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা সন্ধ্যাগুলি । আগে ভাদ্রসংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ পয়লা আশ্বিন ভাদুকে বিসর্জন দিতে লক্ষীসাগরে বিশাল শোভাযাত্রা বের হত, ভাদুর শ্বশুরবাড়ি যাত্রায় সঙ্গে দেওয়া হত আয়না চিরুনি, তেল সিঁদুর আলতা, এমনকি খাট পালঙ্ক, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি পর্যন্ত । ভাদুর শেষযাত্রায় সঙ্গী  গাঁয়ের মেয়ে বউরা যেত গান গাইতে গাইতে  -

“ জলে হেল জলে খেল জলে তোমার কি বটে ! 

আপনার মনকে ভাইবে দেখ জলে শ্বশুরঘর বটে ।।” 

        লক্ষীসাগরের কানাই চন্দ , বনমালী ডাঙ্গুরিয়া, আশিস চন্দ এখনো ভাদু গড়েন । তাঁদের ভাদুর কোলে শোভা পায় কখনো কৃষ্ণ, কখনো টিয়া পাখি, তারা ভাদুর হাতে দেন পান সুপুরি, কখনো ভাদুর হাতে থাকে পদ্ম, কখনো বা শঙ্খ । ভাদুপুজো উপলক্ষে এখনো জিলিপি বানান পাড়ার মিষ্টি দোকানি । কিন্ত আজ ভাদুর আসরে শব্দদানব ডিজে বাজে । গাঁয়ের লোকজন আগের মতোই শোভাযাত্রা বের করে শখের ভাদুকে বিসর্জন দিতে যায় পাশের শিলাবতী নদীতে । কিন্তু ভাদু গান আর শোনা যায় না । কৃষ্ণের বাঁশির শ্রবণ-প্রত্যাশী রাধার মতোই ভাদ্রের ভ্যাপসা সন্ধ্যাগুলিতে ভাদুগানের জন্য আমাদের মন আকুলি-বিকুলি করে ।  



ছবি- লেখক

মুখোমুখি - কবি অমিত সরকার ও কবি মনোতোষ আচার্য



 


গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলা কবিতার শক্তিশালী স্বর কবি অমিত সরকার। অনুসন্ধিৎসু পাঠক মহলে তাঁর কাব্যভাষার পৃথক কদর রয়েছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির উজ্জ্বল মেধার ছাত্র অমিত সরকার প্রযুক্তিবিদের পেশা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু দেশ। বিচিত্র অভিজ্ঞতার ফসলে ঋদ্ধ হয়েছে লেখনী। বহুকৌণিক ও বহুরৈখিক কাব্যস্বর সমবায়ে বাংলা কবিতার নিজস্ব কাঠামো নির্মাণে তিনি সফল। সামাজিক সঙ্গরোধের করোনাবর্তী সময়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন বইতরণী'র পক্ষে কবি মনোতোষ আচার্য। 




মনোতোষ আচার্যঃ নমস্কার অমিতদা, আমরা জানি আপনার জন্ম ১৯৬১--এর ২৪ নভেম্বর, হাওড়ার শিবপুরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল- ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা বেরোলো। নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে মোটামুটি সিরিয়াস কবিতা লিখতে শুরু করলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনি চেনা মুখ অথচ আপনার প্রথম কবিতার বই বেরোলো এই তো সেদিন ২০১২ সালে। প্রথম কবিতা প্রকাশ থেকে প্রথম কবিতার বই প্রকাশের ব্যবধানের নিরিখে আপনি সম্ভবত বাংলায় রেকর্ড গড়লেন। এমনটা হওয়ার কারন কী ?
 
অমিত সরকারঃ দেখো, পেশা একটা অত্যন্ত জরুরী প্রক্রিয়া। যাপন সংগঠিত করার জন্যে প্রত্যেককে তার মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। আর কবিতা একজন ধান্দাবাজ হারামী প্রেমিকা, যে শুধু তোমার রক্ত খাবার জন্যে বসে আছে, তবু এই সত্য জেনেও তাকে ছাড়া যায় না। আমি দীর্ঘ দীর্ঘ সময় গোপনে তার সঙ্গে পরকীয়ায় মেতে থেকেছি। কিন্তু পেশার তাগিদে তাকে তুলে এনে ঘরে বসানোর এই সাহস/ সুবিধে/ সুযোগ তৈরি হতে হতে আমার অনেকটা সময় খরচ হয়ে গেছে। তুমি একে  ব্যক্তিগত মূর্খতা বলতেই পারো বা বলতে পারো অক্ষমের অজুহাত, যা  খুশি ।      

মনোতোষ আচার্যঃ লেখালেখির আদ্য-প্রহরে কাকে বা কাদেরকে মেন্টর হিসেবে পেয়েছিলেন?       

অমিত সরকারঃ একদম শুরুতে আমার বাড়ির উল্টোদিকে একটা প্রেস ছিল। ‘ভাবীযুগ প্রেস’ সেখানে সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন। মূলত রাজনৈতিক কর্মী, কিন্তু লেখালিখি করতেন। ওনার অনেকগুলো উপন্যাসও আছে। তো ওনার একটা কাগজ ছিল, সেটার নামও ‘ভাবীযুগ’। রাজনৈতিক হলেও ওই কাগজে কবিতা, গল্প  এইসবও ছাপা হত। আমি ক্লাস নাইন থেকেই এর প্রতিটা সংখ্যা পড়তাম, তবে তখন আমার মূল আকর্ষণ ছিল প্রবন্ধ। বামঘেঁষা রাজনৈতিক  সাহিত্যের দিকে একটা আপাত লিনিয়ার টান আমার তৈরি হচ্ছিল। ওই প্রেসে প্রতি রবিবার সকালে কেউ কেউ  আসতেন, খানিক কবিতাপাঠ, খানিক সাহিত্য আলোচনা, একটু ননফর্মাল স্টাইলে। সদ্য গজানো শিঙের  সুড়সুড়ি নিয়ে আমিও ওখানে গুঁতিয়েছি কিছুদিন। একদিন সুশীলবাবু ওখানেই আমার কবিতা চাইলেন। ওই কাগজেই প্রথম আমার কবিতা বেরোল স্কুল  ম্যাগাজিনের বাইরে। সালটা সাতাত্তর আটাত্তর হবে। অনেক লিখেছি ওই  কাগজে। তারপর ওখান থেকেই ধীরে ধীরে আলাপ হল কবি  গৌতম চৌধুরী ও অন্যান্য অনেক স্থানীয় কবিদের সঙ্গে। এখানে গৌতম চৌধুরীর কথাটা একটু বিশেষ, কারণ প্রাথমিকভাবে আমার কবিতাযাপনের পুরো পাঠটাই ওনার কাছ থেকে  পাওয়া। ওনার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ নেই। তবু ‘মেন্টর’ শব্দটি বললে গৌতমদার নামই আমি প্রথমে করতে বাধ্য। আমার নিজস্ব কবিতারুচি উনি হাতে ধরে তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন কফিহাউসে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন কবিতাজগতের সঙ্গে।                           


মনোতোষ আচার্যঃ  আপনার ছাত্র জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা যা আজও  আপনাকে একান্তে নাড়া দিয়ে যায়?  

অমিত সরকারঃ ক্লাস সেভেনের একটি ঘটনা বলছি। আমার ক্লাসের একটি ছেলে খেলার মাঝখানে হঠাৎ আর 
একটি ছেলের তলপেটে ঘুষি মেরে বসে। দ্বিতীয় ছেলেটি লুটিয়ে পড়ে, মাঠে থাকার এবং একই দলে খেলার সুবাদে আমিও ওকে ধরে ধরে ক্লাসরুমে নিয়ে গেলাম। দশ মিনিটের মধ্যে শুনলাম ও নাকি মরে গেছে। আমরা কেউই সঠিকভাবে বুঝতে পারি নি। আর  অতটা চোখের সামনে একটি সমবয়সী মৃত্যু…,  জাস্ট নিতে পারি না আজও। ওর রোগা মুখ আজও হন্ট করে। 
আর একটি ঘটনা। গৌতম কর নামে আমার এক সহপাঠী বন্ধু। সে কোথায় আজ আমি জানি না, ও দক্ষিণীতে রবীন্দ্রসংগীত  শিখত। খুব ভালো গাইতো, এবং একটু এফিমিনেট ছিল। অন্য ছেলেরা প্রায়ই ওকে টিজ করতো।  তখন তো এত সচেতনতা ছিল না। আমি ক্লাসে একা ওকে প্রোটেক্ট  করতাম বলতে পারো। একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। আমি ফুটবল মাঠ থেকে ভিজে একশা হয়ে ক্লাসে এসেছি নিজের স্কুলব্যাগটা নিয়ে বাড়ি ফিরব বলে। দেখি ও একা একা ক্লাসে বসে কাঁদছে। আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন করাতে ও বলেছিল ওর খুব ভয় করছে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলাম। আর গৌতম কান্না বন্ধ করে আমাকে একা একা একটি অসাধারণ গান শুনিয়েছিল, ‘বাসন্তী, হে   ভুবনমোহিনী’। গৌতম, তুই যদি কোনভাবে এই লেখা পড়িস তো নিশ্চয়  যোগাযোগ করিস।     

মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কাব্য-জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে কে বা কারা ? 

অমিত সরকারঃ সেভাবে বললে কেউ না। আমার কবিতাজীবনের বেড়ে ওঠা আমার একান্ত নিজস্ব। নিজের ছাড়া এতে কারোর প্রভাব নেই। 

মনোতোষ আচার্যঃ আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নি উৎসব এবং' (২০১২) প্রকাশের অনুভূতি কেমন?      

অমিত সরকারঃ ভাঙা নৌকার নাবিকের কাছে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া কম্পাসের মতো। সেই মুহূর্তেই আমি নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম আমার আগামী যাপনচিত্র কী হতে চলেছে। 

মনোতোষ আচার্যঃ আবেগ ও মেধার মধ্যে কবিতায় কোনটি প্রধান হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

অমিত সরকারঃ আমি তীব্রভাবে প্যাশনেট মানুষ। আবেগ না থাকলে কবিতা লেখা কেন, কোন কিছুই করা সম্ভব নয় বলেই  আমার বিশ্বাস। কারখানায় যখন আমি একজন ধাতুবিদ হিসেবে লোহা গলাচ্ছি, ব্লাস্ট ফার্নেসের ট্যাপ হোল দিয়ে  ১৬৫০০ সেন্টিগ্রেডে তুমুল হইহই নিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্তরং গলানো আলো, সেইসব মুহূর্তেও আমার প্রতিটি ঘামের কণায় অনন্ত  আবেগ লেগে থাকে। না থাকলে হয় না, জাস্ট সম্ভব নয়। তেমনই কবিতার প্রতি আবেগ না থাকলে ঠিকঠাক কবিতা হবে না। নির্মিত ফরমায়েশি কবিতা দেখলে আমার কবিকে লাথি মারতে ইচ্ছে করে। আমি ওই জন্যে পারতপক্ষে “প্রেম বিষয়ে  দুটি কবিতা পাঠান/ ভ্রমণ বিষয়ে তিনটি…” ইত্যাদি অনুরোধকে একদম পাত্তা দিই না, ইগনোর করি। আমার লেখার অভিমুখ কেউ  আগে থেকেই নির্ণয় করে দেবে ভাবলে নিজের ওপর আমার অত্যন্ত বিবমিষা আসে।   
হ্যাঁ, মেধার বিষয়টা ভিন্ন। মেধা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টুল। তুমি অবশ্যই একে ব্যবহার করে নিজের কবিতার উন্নতি করতে পারো। কারণ কবিতারও একটা নিজস্ব ব্যাকরণ আছে। নিয়তিনির্দিষ্ট ইতিহাস ও ঐতিহাসিকতা আছে, ঐতিহ্য আছে।   ওটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তুমি নজরুলের বা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ডিকশনে ২০২০তে বাংলা কবিতা লিখতে পারবে না। কিন্তু লিখতে গেলে ওই ঐতিহ্যটা তোমার জানা প্রয়োজন। এইমুহূর্তে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে গেলে তোমার  জানা প্রয়োজন হাংরি, নিম, ছবিতা, প্রকল্পনা ইত্যাদি এরকম আরও অনেক ঘটে যাওয়া কবিতা আন্দোলনের কণ্ঠস্বর। তাদের সাফল্য ও  ব্যর্থতা। মেধা ছাড়া সেটা জানা বা তাদের আত্তীকরণ সম্ভব নয়। টাইম টেস্টেড কবিতা লিখতে গেলে মেধা  জরুরী। এই দুটো কম্পোনেন্টের মধ্যে কোনটাই প্রধান বা অপ্রধান নয়। দুটোই ভীষণ জরুরী।             
 
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কাব্য-জীবনে পত্র-পত্রিকা সম্পাদকদের ভূমিকা কেমন?

অমিত সরকারঃ আমি বিশ্বাস করি তীব্র মেধা ও উৎকৃষ্ট সাহিত্যরুচি ছাড়া ভালো সম্পাদক হওয়া যায় না। 'অভিমান' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ছোটবেলায় গৌতম চৌধুরীকে ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছিলাম। তখন ওনার কাছে প্রচুর কিছু শিখেছিলাম। এরপরে অনেক বন্ধুবান্ধব কবি ও সম্পাদকদের দেখেছি। ভালো সম্পাদকের আকাল তখনো ছিল, এখন আরও বেশী করে  আছে। একটা ঘটনা বলি, প্রায় দশ বছর আগে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কবি প্রত্যূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ক্যানেস্তারা’ করতেন, চেনো কী না জানি না? আমাকে হঠাৎ করে একদিন আমার পত্রিকা প্রসঙ্গে কাগজের রঙ, কোয়ালিটি, পত্রিকার সাইজ এবং  পাঠকের মনে তার ইমপ্যাক্ট বিষয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। আমি এগুলো জানতাম না। একজন সম্পাদকের এইরকম সব টেকনিক্যাল বিষয়ে গভীর জ্ঞান প্রয়োজন। আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হলেন আফিফ ফুয়াদ। উনি যে পরিশ্রম নিয়ে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ প্রকাশ করেন, কাছ থেকে দেখলে রক্ত জল হয়ে যাবে। উনি কবি নন, কিন্তু ভালো কবিতা চিনে নেবার  জহুরীর চোখ ওনার আছে। প্রভাতদা (চৌধুরী) বা গল্পপত্রিকা ‘দেখা’র সম্পাদক দিব্যেন্দুও খুব ভালো একজন সম্পাদক। নিজে কাগজ করতে গিয়ে প্রকাশক মানবেন্দু রায়ের কাছেও সম্পাদনার বেশ কিছু শিখেছি। আমার মতে উনিও একজন খুব ভালো সম্পাদক । 
তবে বাংলাভাষায় এই মুহূর্তে প্রচুর পাঁঠা প্রজাতির সম্পাদকের রমরমা, যারা শুধু পয়সা /ক্ষমতা /সময় আছে বলেই একটা  পত্রিকা প্রকাশ করে। এদের অনেকেরই ভাষা, বাংলা সিনট্যাক্স, এমনকি বানান বিষয়ে কোন জ্ঞানই নেই। ইদানিং ওয়েবজিন হয়ে  এদের সংখ্যা এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়ছে। এরা হোয়াটসঅ্যাপে বা ইমেলে লেখা চায়, অভ্রতে। পেলে শুধু  কপি পেস্ট মেরে দেয় ব্লগের পাতায়। শব্দ, বানান সংশোধন, বাক্য গঠনের রীতিনীতি, সবকিছুর পশ্চাৎদেশ এরা ক্রমাগত একসঙ্গে মেরে চলেছে। এবং এবিষয়ে কোন অনুতাপ বোধ পর্যন্ত এদের নেই। উদাহরণ চারপাশে খুঁজলেই পাবে।       
 
মনোতোষ আচার্যঃ আপনার অনুভূতিতে মহৎ কবিতার স্বরূপ কী?         

অমিত সরকারঃ এককথায় বললে টাইম টেস্টেড বা টিকে থাকা। মহৎ কবিতা একটি নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক বিন্দুতে সাহিত্য ও  সময়কে কালের প্রেক্ষিতে বুঝে নিতে সাহায্য করে। মহৎ কবিতায় আমাদের চারপাশের লোভ, অস্থিরতা, রাজনীতি, ক্ষমতাপ্রহসন, ভণ্ডামি, ধর্ম, মূর্খতা, বর্বরতা, বিকেল, হতাশা, নিঃসঙ্গ অন্ধকার, বায়বীয়তা ইত্যাদি ঘুরতে ঘুরতে একটা শরীর গ্রহণ করে। এবং সেই শরীর ধীরে ধীরে  পূর্ণ একটি সত্তার জন্ম ও বোধ দেয়। সেই সত্তাকে আলোড়িত করে চারপাশের ব্যস্ত  মানুষদের বিচিত্র মুখ। হারিয়ে যাওয়া,  বিস্ময়  জাগানিয়া, সামাজিক, লোভী, পাগল, খুনী ইত্যাদি সবরকম মুখ। মহৎ কবিতায় এই মুখ  বা মুখোশের সারিরা মাথার ভেতরে ঘুণপোকা হয়ে ঢুকে পড়ে, যাদের তুমি এড়াতে পারবে না। এবং তাকে গতি দেয় সময়ের ভেক্টর, তাই টাইমফ্রেম পেরিয়ে সে একাই এগিয়ে চলে কালনিরপেক্ষ ভাবে। তবে ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বা  ব্যক্তিঅনুভূতির  প্রাবল্য  ছাড়া  মহৎ কবিতার  স্থানাঙ্ককে অবশ্যই আইসোলেট করা যায় না।      

মনোতোষ আচার্যঃ কেউ কেউ বলেন-- কবিতা হল আত্ম-নির্মাণ ও আত্মজৈবনিক --এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? 

অমিত সরকারঃ হওয়া উচিত কিন্তু সবসময় হয় না। সারা পৃথিবীতে রোজ লক্ষ লক্ষ কবিতা নির্মাণ হয়। যে কোন বড় ঘটনার পরে ফেবু খুললেই দেখা যায় সেই বিষয়ে লাখ লাখ কবিতা। এদের মধ্যে স্ট্যাটিস্টিক্যালি ভালো কবিতা থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করি কি করে ? তবে আত্মনির্মিত কবিতা আমার পছন্দের জঁর। এটাও কারণ হতে পারে আমি ফরমায়েশী  কবিতা লিখতে পারি না বলে। 

মনোতোষ আচার্যঃ  বাংলা ভাষায় লিটল ম্যাগাজিনের ভাণ্ডারটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এখনো বহু পত্র-পত্রিকা এখান থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তবু আপনি ২০১২ থেকে 'চর্যাপদ' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় এলেন। আপনার কী ভয় হয় না এত ম্যাগাজিনের ভিড়ে আপনার 'চর্যাপদ' হারিয়ে যেতে পারে?       

অমিত সরকারঃ আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। বাংলা ভাষায় ভালো কবিতার কাগজ আমার মতে আঙুল গুনলে কুড়ি  পেরোবে না। এইসব ট্র্যাশের ভিড় থেকে নিজেদের লেখার মত একটা উপযুক্ত ক্যানভাস তৈরি করতেই আমি চর্যাপদ তৈরি করি। আর চর্যাপদ নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। আমার যে কোন কাজের মত এতেও আমি কনফিডেন্ট।   

মনোতোষ আচার্যঃ  আশির দশকের কোন কোন কবির প্রতি আপনার অধিক মনোযোগ ছিল ?   

অমিত সরকারঃ সেভাবে ভাবি না। অ্যাকচুয়ালি দশক বিভাজনে আমার কোন বিশ্বাস নেই। কখনো ছিল না। বহুবার এ নিয়ে লিখেছি, বলেছি, বিতর্ক করেছি। সমকালীনতা নিয়ে ততটা মনোযোগ দেবার কথা ভাবিনি কখনো। বরং বাংলা কবিতায় নিজের জায়গার কথাটাই ভাবতে চাই।  

মনোতোষ আচার্যঃ কবিতা কেন লেখেন নাকি কবিতা আপনাকে লিখিয়ে নেয়?

অমিত সরকারঃ লিখিয়ে নেয় কথাটাই সত্যি। আমাকে অত্যাচার করে ও লিখিয়ে নেয়। আমি আমার মাথার ভেতরে কবিতার ঘুণপোকার যে ম্যালিগন্যান্ট কামড়, তা থেকে বাঁচার জন্যে ওকে ল্যাপটপে উগরে দিতে বাধ্য হই।             

মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কিছু কিছু কবিতায় প্রাচীন সাহিত্য, পুরাণ-প্রসঙ্গ, ধর্ম, দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে উঠে এসেছে। এই পরিসরগুলোকে আপনি কীভাবে ধরেন?     

অমিত সরকারঃ সচেতন ভাবে ধরি না তো। আমার কবিতায় অটোম্যাটিকালি এরা উঠে আসে। আমি একই সঙ্গে আজ ও পাঁচশো বছর বা এগারোশো বছর আগে ঘুরে বেড়াতে পারি। আমি কাহ্নর সঙ্গে  চিঅন বাকল দিয়ে তৈরি বারুণী মদ পান করেছি। আবার চৈতন্যের পার্ষদ হয়ে পুরীর রাস্তায় নাচতে নাচতে হেঁটে গেছি। গৌড় থেকে শশাঙ্কর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি, শবরীর জন্যে গুঞ্জা ফলের মালা গেঁথেছি, আবার তোমাকে মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করেছি। এই সময়ভ্রমণ আমার ব্যক্তিগত চরিত্র লক্ষণ, তাই আমার কবিতায় তার অনিবার্য প্রতিফলন থাকবেই।       

মনোতোষ আচার্যঃ আপনার লেখা 'জলপরিদের শীৎকারগাথা', 'বাউলানি তোমায়', 'অপ্রেমে আজানে', 'নির্জনে সিপিয়া অ্যালবাম' পড়ার পর পাঠক ভিন্নতর কাব্যভাষার স্বাদ পাচ্ছেন 'রাতের লোকাল ট্রেনে যদি কখনো ফেরো' -- এই ভিন্নতার পেছনে আপনার সচেতন প্রয়াস কতখানি?

অমিত সরকারঃ আমার প্রত্যেকটা কবিতাবইতেই আমি কিছুটা কিছুটা পাল্টেছি। সিগনেচারটা এক রেখে আমি নিজেকে  বারবার পাল্টাতে ভালোবাসি। মাঝে মাঝে আমি সচেতন ভাবেই নিজের সমস্ত কোষবিভাজনকে পাল্টে ফেলি। এই ভাবেই  বেঁচে থাকতে ভালোবাসি।  

মনোতোষ আচার্যঃ  কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কাকে মনে করেন?    
 
অমিত সরকারঃ অবশ্যই নিজেকে। 

মনোতোষ আচার্যঃ কবিতায় ব্যক্তি 'আমি'কে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া উচিত বলে মনে হয় ?

অমিত সরকারঃ পুরোপুরি। নিজের চেয়ে বেশী অন্য কিছুকে তো আমি জানতে পারি না। 


মনোতোষ আচার্যঃ কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?  

অমিত সরকারঃ কবি তো আল্টিমেটলি একজন মানুষ, যে আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে, সকালে বাজার যায়, অফিস ফেরত  বউয়ের  জন্যে সিঙ্গাড়া  কিনে বাড়ি ফেরে। মেয়ের কলেজের ফিজ, মায়ের  ওষুধ, বাবার অপারেশনের খরচ, অফিসে বসের খিস্তি এগুলো তো তার  জন্যে বরাদ্দ রয়েছেই। 
এর বাইরে সে যখন লিখছে, তখন কিন্তু সে ল্যাপটপ স্ক্রিনের সামনে একজন সম্রাট। সেই মুহূর্তে কারুর কাছে তার কোন  দায়বদ্ধতা নেই, দেনা নেই। সে সমাজ পাল্টানোর জন্যে কবিতা লিখুক আমি চাই না।  

মনোতোষ আচার্যঃ অতি সম্প্রতি এমন কোনো তরুণ কবির বই পড়লেন যার মধ্যে সম্ভাবনার বীজ উপ্ত হয়েছে?

অমিত সরকারঃ অনেক। শুভম চক্রবর্তী,  বুদ্ধদেব হালদার, তন্ময় মণ্ডল, আরও অনেকে আছে। সবাইয়ের নাম মনে পড়ছে না। 

মনোতোষ আচার্যঃ কবিতায় ছন্দ ব্যবহার বিষয়ে আপনার বিশেষ কোনো অভিমত আছে কী? 

অমিত সরকারঃ এটা তো একটা টুল মাত্র। তোমার হাতে এটা থাকলে ভালো। না থাকলেও ক্ষতি নেই তেমন। আমি টেকনিক্যালি ছন্দটাকে ভালোই জানি। কিন্তু আমি আর ছন্দে লিখি না। আগে অনেক লিখেছি অবশ্য, তবে ওটা আর আমার পছন্দের রাস্তা নয়। 
         


মনোতোষ আচার্যঃ সম্প্রতি বাংলা কবিতাকে ঘিরে এক 'নেক্সাস' গড়ে উঠেছে। এই নেক্সাসের পেছনে কী কোনো কায়েমি স্বার্থ নেই?

অমিত সরকারঃ সিওর আছে। দাদাকবি, দিদিকবিদের টিকে থাকতে গেলে ওই নেক্সাস অবশ্য প্রয়োজন। আর তরুণ কবি, যার নিজের হাতের ওপর কনফিডেন্স নেই, তাকে কল্কে পেতে গেলে, মানে বিভিন্ন কবি সম্মেলনের ডাক, পুরস্কার টুরস্কার,  বাইরে একটু ভালো হোটেল, ফ্রি মদ খাওয়া, এইসব পেতে গেলেও ওই নেক্সাস লাগে। এইসবের জন্যেই এই আবর্জনাগুলো  তৈরি হয়।    

মনোতোষ আচার্যঃ জীবনে প্রথম লেখা গল্প 'চারণভূমি' ২০১৬ সালে 'দেশ' পত্রিকায়  প্রকাশিত হতেই প্রচুর পাঠকের ভালোবাসা, সিনিয়র গল্পকারদের শুভেচ্ছা , উৎসাহ পেলেন। এত ভালোবাসার রহস্য কী? 

অমিত সরকারঃ এটা আমি সঠিক জানি না। বোধহয় নিজের যাপন অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যের সঙ্গে ঠিকঠাক ব্লেন্ড করতে  পেরেছিলাম বলে । মনে হয় ককটেলটা ঠিক ছিল।       


মনোতোষ আচার্যঃ গল্প লিখতে এলেন কার প্রেরণায়? 

অমিত সরকারঃ ম্যাডাম, মানে অরণ্যা সরকারের। আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম জীবনে কোনোদিন কবিতা বা কবিতা বিষয়ক গদ্য ছাড়া আর কিছু লিখবো না। একমাত্র ওর জোরাজোরির ফলেই গল্পের সীমান্তরেখায় আমার অনুপ্রবেশ। আর বউয়ের সঙ্গে কোন শালা কবে তর্কে জিতেছে ?      

মনোতোষ আচার্যঃ লং ড্রাইভিং এর পাশাপাশি খোঁজ পেয়েছি  আপনার আরও এক নেশা ফোটোগ্রাফির বিষয়ে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কারও পেয়েছেন। এই ব্যাপারে যদি কিছু বলেন?

অমিত সরকারঃ আমার ছবি তোলার নেশা বহু বছর ধরে। ভ্রমণের সঙ্গে তো এটা জড়িয়েই থাকে। আমি ফর্মালি ফটোগ্রাফির কোর্সও করেছি। তবে বেশ কয়েক বছর আগে কিছু সঙ্গী ফটোগ্রাফারের পাল্লায় পড়ে, ইংল্যান্ডে একটি কম্পিটিশনে যোগ  দিই, এবং খানিকটা ভালো রকম অর্থমূল্যেই পুরস্কৃত হই। তারপর দরজাটা খুলে যায়।  এখনও অবধি আটটা দেশ থেকে  ছবির জন্যে স্বীকৃতি পেয়েছি। এদেশেও অনেকগুলো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি অবশ্য। অর্থ ও সম্মান দুটোই যখন আসছে ক্ষতি কী ?      

মনোতোষ আচার্যঃ আপনার কী মনে হয় সরকারি/ বেসরকারি পুরস্কার একজন কবির জীবনে অত্যন্ত জরুরি?  

অমিত সরকারঃ দেখো, ছবির অ্যাওয়ার্ডের সঙ্গে সাধারণত একটা অর্থমুল্য জড়িয়েই থাকে। ওটাই একটা বিরাট মোটিভেশন।   প্লাস ছবি বিক্রিও হয়ে যায় অনেক সহজে। কিন্তু লেখালিখির সঙ্গে এখানে তো একদমই অর্থ জড়িয়ে নেই। তাই মঞ্চে ওই স্বীকৃতিটুকু পাওয়া গেলেও একটা রেকগনিশনের ফিল আসে।  মনে হয় লেখার জন্যে আমার এই শ্রমটার একটা স্বীকৃতি পাঠকেরা দিল। তাই পুরস্কারটা জরুরী। এটা কনফিডেন্স বুস্ট আপ করে।   

মনোতোষ আচার্যঃ আপনারও কি প্রশ্ন জাগে চারিদিকে 'বহুপ্রসূ অথচ বন্ধ্যা' কলমের এত ভিড় কেন?       

অমিত সরকারঃ সঠিক এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার নিজস্ব মত হচ্ছে, ইদানীং একটা মেধার ডেকাডেন্স কাজ করছে।  লেখা প্রকাশ ই-মিডিয়া আর ফেসবুকের কল্যাণে এত সহজ হয়ে গেছে, যে মাঠে নামার আগে প্রয়োজনীয় অনুশীলনটাই কেউ করছে না। তুমি এদের কাউকে চা খেতে খেতে হঠাৎ জিজ্ঞেস কর, উৎপল কুমার বসু, দেবদাস আচার্য, বা শম্ভু রক্ষিতের  কবিতা  পড়েছে কী না ?  পড়লে কোন  কবিতা বা বইটা পড়েছে ? কেন ভালো লেগেছে ? উত্তরটা পেয়ে যাবে বলে মনে হয়। এঁদের নামটা শুধু উদাহরণ হিসেবেই তুললাম। প্রস্তুতি না থাকলে কিছুতেই সফল হওয়া যায় না বন্ধু।        



মনোতোষ আচার্যঃ আপনার পরবর্তী সময়ের সাহিত্যসেবীদের প্রতি আপনার বার্তাটি ঠিক কেমন?

অমিত সরকারঃ ভাই, আমি প্রফেটিক হয়ে যেতে চাই না। আমার লড়াইটা প্রতিদিন আমাকেই লড়তে হয়। তাদেরটাও তাদেরকে। আমি উপদেশ দেবার জায়গায় একদম নেই। 

মনোতোষ আচার্যঃ ধন্যবাদ অমিতদা, বইতরণী'র পাঠকদের জন্য এতটা সময় দেওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে সুযোগ পেলে আবার কথা হবে। এখন আপাতত এই পর্যন্ত... 

অমিত সরকারঃ সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া। শুভেচ্ছা রইলো।             



  
                                            

গল্প - তীর্থঙ্কর নন্দী


 অমনোনীত গল্প

----------------------


একটি গল্প কখনও কোথাও মনোনীত হয় না। কেন হয় না বোঝা মুশকিল। গল্পটি যেখানেই পাঠানো হক না কেন ঘুরে ফিরে ফেরত আসবেই। গল্পটির কোথায় সমস্যা কেন সমস্যা বোঝা যায় না। অমনোনীত গল্পটি শুরু হয় এই ভাবে। 

একটি প্রায় নির্জন রাস্তা চলে যায় এই শহরের দক্ষিণে। রাস্তাটি আসে শহরতলি থেকে। প্রায় নির্জন মানে ঘরবাড়ি আছে তবে একটু কম। ফাঁকা ফাঁকা। এখনও খালি জমি পড়ে থাকে বাঁ দিকে ডান দিকে। কয়েক বছর বাদে এই ফাঁকা জমিও ভরাট হয়ে যাবে। রাস্তাটি যতই দক্ষিণ শহরে এগোয় ততই রাস্তাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। ঘরবাড়ি যেন মুখের ওপর এসে পড়ে। এই দক্ষিণ শহরের রাস্তায় মোমোদের বাড়ি। মোমোরা থাকে। মোমো নামি স্কুলের ছাত্রী। আশেপাশের বাড়ির লোকেরা একদিন খেয়াল করে মোমোকে নিতে স্কুলের গাড়ি আসে না। প্রায় এক সপ্তাহ বাদে মোমোকে আবার স্কুলে যেতে দেখতে পাওয়া যায়। কানাঘুষো শুনতে পায় এই এলাকার মানুষ যে এক সপ্তাহ নাকি মোমো বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। কানাঘুষো খবরটি স্বভাবতই ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির পরিচারিকাদের মাধ্যমে। এই এলাকায় চারজন মহিলা ঘুরে ফিরে বারোটি বাড়িতে কাজ করে। খবর এদের মাধ্যমেই ছড়ায়। মোমোদের বাড়িতে যেই মহিলা কাজ করে প্রধানত সেই মহিলাই বাকি তিনজনকে জানায়। 

কথা হল মেয়েটি এক সপ্তাহ কোথায় থাকে! কেন থাকে! কীভাবে থাকে! আসল খবরটি কেউই জানতে পারে না। জানার কথাও নয়। কেননা মোমোর অভিভাবকেরা জানে মুখে কুলুপ এঁটে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিছুদিন বাদে সবকিছু চাপা পড়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ফলে মোমোর অদৃশ্য হওয়ার আসল কারণটি জানা যায় না বলেই কি গল্পটি অমনোনীত হয়! সম্পাদকেরা মনে হয় আসল কারণটি জানতে খুবই আগ্রহী। ফলে আসল কারণটি অজ্ঞাত থাকার ফলেই বোধ হয় কোন সম্পাদক গল্পটি প্রকাশ করতে রাজি হয় না। গল্পটি ঘুরে ফিরে ফেরত আসে। 


দেবদূত থাকে এই শহরের উত্তরে। দেবদূত ভালো ছাত্র। উচ্চবংশের ছেলে। উত্তরের শহরটি এখনও কেমন এলোমেলো। অগোছালো। রাস্তাঘাট ভাল হয়নি। প্রচুর ঘরবাড়ি। নোংরা। অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিবেশ এই উত্তর শহর। দেবদূত এই শহরের দক্ষিণে একটা স্কুলে পড়ত। ভাল স্কুল। কো-এড। দেবদূত এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। মোমো এই স্কুলেই পড়ে। এখনও পড়ে। দেবদূত আর মোমোর ভিতর এক ধরণের মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে দেবদূত যখন স্কুলের ছাত্র ছিল। সম্পর্কটি এখনও আছে। 

প্রায় প্রতিদিন আশেপাশের লোকেরা দেবদূতকে মোমোর বাড়ি আসতে দেখে। দেবদূতের একটি লাল রঙের মোটরবাইক আছে। ফলে বাইকটিকে মোমোর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো থাকলেই মানুষ বুঝে যায় বাইকের মালিক কোন বাড়িতে আসে। অবশ্য বর্তমানকালে একটি ছেলে একটি মেয়ের বাড়িতে রোজ আসবে গল্প করবে এটা কোন বিষয়ই নয়। দুজনেই যখন একই স্কুলে পড়ে। একই স্কুলের গল্প অন্যান্য বাড়িতেও আছে। থাকবে। ফলে এই সব দৃশ্য এই সব গল্প মানুষের কাছে আজ আর কোন নতুন নয়। পুরনো। একঘেয়ে বিষয়ে মানুষ এখন আর মন দেয় না। মোমো যখন তার বাড়ি থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায় তখন কিন্তু দেবদূতও আর মোমোর বাড়িতে আসত না। ফলে মোমোর আশেপাশের মানুষরা দেবদূতকে নিয়ে এক মনগড়া গল্প ফাঁদে। যে গল্প পরিচারিকাদের মুখ থেকে শোনা যায় না সেই গল্পই মোমোর প্রতিবেশীরা বলতে থাকে। তারা বলে মোমো নাকি দেবদূতকে নিয়েই কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ এই গল্পের কোনও সত্যতা নেই। কেননা মোমোর বাবা মা এই ধরণের কোনও কথা বাইরের লোক কিংবা থানাতে কখনও বলে নি। হয়তো এই সব মনগড়া গল্পের জন্যও কোনও সম্পাদক গল্পটি প্রকাশ করতে সাহস পায় না। গল্পটি অমনোনীতই থেকে যায়। 


আজ সোমবার। পয়লা ভাদ্র। গুমোট গরম চারিদিকে। শহরের বুকে কিংবা বলা যায় এই বিশ্বশহরে মানুষ কেমন অসহায়। এক অজানা ভাইরাসে গুমরে থাকে। মনে করে দিন দিন যেন মৃত্যু কাছে আসে। কিন্তু ঈশ্বরের জন্য অপেক্ষা করা যায়। তা বলে মৃত্যু! ইতিহাসে ত এমন কথা কেউ বলেনি যে মৃত্যুর জন্য কেউ অপেক্ষা করে! কিন্তু তমালিকা করে। তমালিকা এখন দিনরাত মৃত্যু চায়। চায় মৃত্যু যেন তাকে গ্রাস করে। এই মৃত্যু চাওয়ার ভিতর যথেষ্ট কারণ আছে। 

কে এই তমালিকা! কেন সে দিনরাত মৃত্যুকামনা করে! তমালিকা থাকে শহরতলীতে। রূপগঞ্জে। এই শহর থেকে রূপগঞ্জে যেতে মাত্র তিনঘণ্টা লাগে বাসে। রূপগঞ্জের অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে তমালিকা। বাবা ছিল উকিল। মামা উকিল। কাকা উকিল। দুদিকের দাদুরাও উকিল। মানে উকিল পরিবার। তমালিকাও উকিল হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। পড়াশোনার মাঝেই তমালিকার বিয়ে হয়ে যায়। স্কুলে পড়াশোনার সময়ই তমালিকা উকিলের স্বপ্ন দেখে। যেহেতু পরিবারের সবাই উকিল আর উকিল। তমালিকার বিয়ে হয় একজন নামজাদা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। তমালিকার পিতা ঈশ্বর প্রমোদরঞ্জন মহাশয় তমালিকার বিয়ে নিজে হাতে দিয়ে যান। অত্যন্ত পণ্ডিত বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন। পাত্র নির্বাচনেও কোনও ভুল ছিল না। অন্তত বিয়ে পর্যন্ত। 

কথায় আছে যত গোল বাঁধে পরে। কিন্তু সর্বত্রই কি গোল বাঁধে! গোল বাঁধাটাই কি নিয়তি! তাহলে ত সবার জীবনেই বিয়ের পর গোল বেঁধে যেত। কিন্তু যায়নি ত! তমালিকার বন্ধু নীলাদ্রি ত বেশ আছে। নীলাদ্রির বন্ধু ঋতমাও ত বেশ আছে। তাহলে! ভাগ্যবিচারকেরা বলে সবই নাকি ভাগ্য। তমালিকা একদিন শহরে আসে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে। সেদিন ছিল ঝলমলে আকাশ। শীতকাল। দুজনে মিলে ঘুরতে যায় ময়দানে। ময়দানে চক্কর মারতে মারতে বসে পড়ে এক টিয়াপাখি বিচারকের কাছে। টিয়াপাখি কত বড় বিচারক! কত বড় উকিল! লোকে বলে টিয়াপাখি নাকি সব নিখুঁত বলতে পারে। দুই বন্ধু টিয়াপাখির কাছে বসে বিচার চায়। সবুজ টিয়াপাখি লাল ঠোঁট নিয়ে দুই বন্ধুর ভাগ্যগণনা করে। ভাগ্যে বলা থাকে দুজনেই কপালমন্দা। 

তমালিকা যে কপালমন্দা সেটা তমালিকার থেকে কেউ ভাল জানে না। ছ বছরের মাথায় স্বামী ধীমান তমালিকাকে ছেড়ে চলে যায়। তমালিকা সেই থেকে এক ছেলেকে নিয়ে বাবা মার কাছেই থাকে। ধীমান কেন ছেড়ে যায় কী তার আসল কারণ সেই কথা কেউ জানে না। সেই রহস্য একমাত্র ধীমান আর তমালিকাই জানে। এই অসহ্য জীবন তমালিকার একদম ভাল লাগে না। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর কথা ভাবে। আত্মহত্যার কথা ভাবে। কিন্তু আত্মহত্যা থেকে বার বার ফিরে আসে একমাত্র ছেলের জন্য। ধীমান আর তমালিকার বৈবাহিক জীবন কেন সুখের হল না সেই রহস্য পরিষ্কার হয় না বলেই কি গল্পটি মনোনীত হয় না কোথাও। গল্পটি অমনোনীতই থেকে যায়।


শান্তিনগরে থাকে বব আর ববি। এই শহর থেকে শান্তিনগর বেশ দূরে। নিজস্ব গাড়ি থাকলে ছ ঘণ্টা। বাসে সাত ঘণ্টা। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জায়গা শান্তিনগর। লোকে বলে এই কারণেই নাকি নাম শান্তিনগর। অনেকটা জায়গা নিয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা একটি অঞ্চল আছে। নাম শান্তিবন। মানুষ প্রতিদিন বিকালে এখানে এসে একটু শান্তি খোঁজে। মনের আরাম খোঁজে।

বব আর ববি শৈশবের বন্ধু। শুধু শৈশবের কেন হবে! বালক বয়সের যুবক বয়সেরও বন্ধু। এখন তো দুজনে মাঝবয়সে দাঁড়িয়ে। যুবক থাকতেই দুজনে মিলে একটি ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়। ওদের ব্যবসার সুনাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসার দৌলতে দুজনেই আজ বেশ ধনী। দুজনেরই বিদেশি গাড়ি। দুই বন্ধুর এমন ভাল সম্পর্ক খুব কমই চোখে দেখা যায়। যেন হরিহর আত্মা। কাজে কর্মে যখনই দুজনে বিদেশে যায় সঙ্গে দুই পরিবারও থাকে। বেশ চলছিল ব্যবসা ও বন্ধুত্ব। 

শান্তিনগরের মানুষ এখন অন্য ছবি দেখে। ছবিটি বেশিদিনের না। মাত্র এক সপ্তাহ হয়তো হবে। বব ববির মুখোমুখি হলে দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আবার ববি ববের মুখোমুখি হলে দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। কেন এমন হল বাইরের কেউ জানে না। কার দোষ কেউ বুঝতে পারে না। অফিস ঘরটি তালাবন্ধ। অথচ এই অফিসেই এক সময় কত মানুষ আসত। গমগম করত। এখন চুপচাপ। দুজনের এই তেতো সম্পর্কের জন্য শান্তিনগরের মানুষের ভিতরেই এক অশান্তি। প্রায় দিন বিকালেই দুই বন্ধু শান্তিবনে আসত। গল্প করত। ব্যবসা নিয়ে আলোচনা চলত। শান্তিতে দুজনের কত কথা হত। বিকালে যারা এইখানে আসত সবাই দুই বন্ধুচিত্র দেখে অভ্যস্ত ছিল। আজ আর দুই বন্ধু এই বনে আসে না। বসে না। গল্পও করে না। দুই বন্ধুর অনুপস্থিতির জন্য বিকালে যেন মানুষের চোখে শান্তিবন কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগে। ধূসর লাগে। 

দুই বন্ধুর নিমসম্পর্কের জন্য কে দায়ী! বব না ববি! মানুষ কিছুই বুঝতে পারে না বাইরে থেকে। তারা শুধু দেখে একটি মধুর সম্পর্ক কীভাবে রাতারাতি তলানিতে এসে ঠেকে। কীভাবে সম্পর্কটির পতন হয়। পতন কি অর্থের জন্য! অতিলোভের জন্য! না অন্য কিছু! শান্তিনগরের মানুষদের কাছে এই রহস্য কখনও পরিষ্কার হয় না। হবেও না। ফলে শান্তিনগরের মানুষের কাছে যদি গল্পটি অধরা থাকে তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকের কাছে গল্পটি কীভাবে ধরা দেবে! সেই জন্য গল্পটি আজও অমনোনীত। কোথাও ছাপা হল না।


অলংকরণ- কার্তিক ঢক্

দীর্ঘ কবিতা - বেবী সাউ


আত্মানাংবিধি

------------------


মুছেছি রাতদিন মুচছি মৃদুশোক

উঠছে বেজে বাঁশি; রাত্রি ভাঙা আলো

অপার আনন্দে, সেও বিস্তারিত 

ধুলোয় রাস্তার দৃশ্য অবগত...


তাহার প্রান্তের দৃশ্য উড়ে যায় 

তাহার হাতে বসে শান্ত বনপথ... 

গ্রীষ্ম ভেঙে গেছে তৃষ্ণা তার আজ

আঁচলা ভরে দেব, এই রক্তপাতে? 


অতীত ভেসে যায়, বোঝে জন্মবোধ 

হাঁটছে একা একা প্রকৃত বারবেলা 

এ অনুশাসনের বিরাট দৃশ্যটি

কান্না দেবে তাকে? বিষাদে চারপাশ?... 


আসল শকুনের চোখের পরপারে 

তুমিও শিখে গেছ ফাঁদের কৌশল 

তর্কে অহেতুক প্রথমে বহুদূর 

যেসব তথ্যের ভাঙাও প্রথাগত... 

ভেঙেছে সংসার ভাঙা আর্শিকাচ 

নেভানো উনুন সে ঘন চুম্বনের 

মৃদু আঁচে সেও বুঝছে বনপথ  

ইনশাআল্লাহ ইনশাআল্লাহ 



যেপথ পারাপার যেপথ তথ্যের 

পেরিয়ে গেছে সেই অতীত আলোটিও 

তাকে কী তুমি দেবে সহায়কালটিকে

বলবে তুলে ধরে 'তুমি সর্বস্ব'... 


তাকেই দেব আমি,  আজান কালবেলা 

পুবের রোদ দেব, অবাক পরিযায়ী... 

মৃতের চোখ বেয়ে আজও অশ্রুধারা 

ভেজা সে আলোটিকে ডাকবে 'আনন্দী'! 


এসো হে পথগান, এসো তো ঘরে আজ 

যা কিছু আছে দেব দু'মুঠো দই চিঁড়ে 

পথিক তুমি হলে এ পথ আমারও যে 

ধুলোতে লিখে রাখি ফেরার মথুরাকে...



দুঃখে ভিজে উঠি, সুখের জ্বালা চোখে 

বিরহ বেলা যায় পথের নিশানায় 

গভীর হলে পথ, কিংবা খাদময় 

দেবে কী তুমি হাত, ধরার ছলনায়! 

এ পথ বাঁশুরীর, বাঁশীটি ডাক দেয় 

মেঘেতে ভরে ওঠে সমাজ সংসার 

করুণ বিরহ যে তাহার পাশে লিখি 

একলা রাধিকারা গাইছে জারিগান... 


বিদায় ঘন হলে, সময়ে ভাসে চোখ 

ডাকছে হাঁসদল জলের সংসারে 

জমিয়ে রাখা সেই রাজ্য নীতিহীন 

বিরহ জাগাবে না, দু'চোখে জল ভরে? 


'


যেসব চোরাবালি বুঝেছে মর্মর 

পা'য়েতে দহলিজ ওপারে জন্নত

আঁকছি কালবেলা, রোজই তো মেনে নেওয়া

আঘাত দিতে দিতে শিখেছি ক্ষত চেনা...

 

কে তাকে অনুভবে রাস্তা দিতে পারে! 

কে সেই অভিমান, একা অনুসরণে

শান্ত চোখ জানে, এ মেঘ বর্ষণে 

অধিক যত্ন নিতে কাজল চোখে টানে...


এভাবে মুখ টিপে জ্যোৎস্নার আলো 

ঘটছে চারপাশে ব্যাপার ছোটোখাটো 

এখানে যেমনটি বুদ্ধ বলেছেন

ওপারে ক্রাইস্ট লেখে ক্রুশরক্ত...


আমিও আমাদের তুমিও তোমাদের 

ভাতের রোজগার গন্ধ ছেঁকে তোল 

জিভের স্বাদটুকু বুঝেছে মহিষেরা 

বুঝেছে ঘাসপাতা হিমের সাদা চোখ


হিংসার রঙ জানে রক্ত খুনী হাত

জিভটি লকলকে যে হিমোগ্লোবিনে 

তাকেও ফাঁদ দেবে, তাকেও ভোট বলে

আড়ালে ডেকে আজ শেখাবে কৌশল!  


গলছে ধানক্ষেত জমাট শীতবন 

লেগেছে ফাটাঠোঁটে পুরুষ বোরোলীন 

হাঁটছে আয়োজন আর্কাইভে সেজে

ম্যাপল বনেতেই সারাহ নতুনের

মধ্যরাতে শ্বাস বন্ধ করিডোরে

চড়ুই পালকের ভ্রান্ত দিক গান 

ধীরে সাধ্যাতীত জমানো রুকস্যাক 

নামতা ভ্রমণের গল্প লিখে ফেলে...

 

রেখায় বৈষ্ণব ভাসে পদ্ম-প্রেম

নীচেই কোরকের বিষাক্ত ছোবল 

বালিশে ঘামনুন ঘ্রাণের জটিলতা 

আবার কেঁপে ওঠে এ অগ্রহায়ণ 

ভাতের লোভ তাকে দিয়েছে বশ্যতা! 

কে যেন দিয়ে যায় খিদের ভরা ঋণ 

শরীরে ঘুম ঘুম বনেদী দরজায়

কে দেবে বিপ্লব! কেমন অধিকার!

এ দেশ গরীবের রক্তে নাচে ধিন ধিন... 



তবুও অন্ধেরা করছে শুরুয়াৎ 

বিরাট বক্রতা মৃতের নাম আর

এই মহম্মদ অন্ধ আকবর 

ওপাশে বুদ্ধের এ জীবনাবসান 

এপাশ কেঁদেছিল জমা জন্মবোধে 

ভেঙেছে ব্যারিকেড সোপান রাত্রির 

তবু কী পেরেছিল অশ্রুজল ধুতে? 

পেরেছে আজও কি সে দু'মুঠো ভাত দিতে?



ডানার ধ্বনি বাজে নারীর অবসাদে 

অতল এক জোড়া এয়োতি শাঁখা-পলা 

ভোরের আলো নিয়ে কাগজ বিক্রেতা 

রক্তঠোঁটে বাজে ভাঙা মূল্যবোধ 

জেনেছে সেও বুঝি 'আত্মানাং বিধি' 

পথের চিৎকার 'অহম অস্মি' শোক 

জীবন একটাই জীবন একটাই 

ভাতের শোকে তার মৃত্যু আঁকা হোক...



এ ভূমি আমাদের এ ভূমি তোমাদের 

ধর্ম সবটাই বাঁচার মতো হোক... 










অলংকরণ- কার্তিক ঢক্




কথামুখ

 অপুর্ব  জীববৈচিত্র্য ভরা আমাদের এই পৃথিবী। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের জন্য, তাদের অমানবিক ও অবিবেচকের মতো বিভিন্ন কার্মকান্ডের জন্য...